দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা দুই সুপার পাওয়ারের মধ্যে শুরু হয়েছিল ঠান্ডা লড়াই। অর্থনীতি, বিশ্বরাজনীতি, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই একে অন্যকে ছাপিয়ে যাবার এই চেষ্টা বিশ্বে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করেছিল। যার ফলে গোটা বিশ্ব প্রায় দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালের মার্চ মাস, প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপের কাছে গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিন 'K-১২৯' টহল দিচ্ছিল। কিন্তু সাবমেরিনটির সাথে সমস্ত যোগাযোগ হঠাৎই ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর কোনওদিন সাবমেরিনটির কোন খোঁজ পায়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এরপরই শুরু হয় আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর প্রজেক্ট 'অ্যাজোরিয়ান,' অত্যান্ত গোপন এই প্রজেক্ট সম্পর্কে সিআইএ ও হোয়াইট হাউসের মাত্র দশজন জানত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমেরিকার থেকেও পরমানু অস্ত্রের সংখ্যা সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে তখন বেশী। যার জন্য আমেরিকা বাধ্য হয়ে তাদের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এবং এফবিআই প্রতিনিয়ত সোভিয়েত ইউনিয়নের একের পর এক প্রযুক্তির উপর নজরদারি করতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালের ১৯ মার্চ আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপের ২৬০০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরে কে-১২৯ সাবমেরিনটিতে প্রচন্ড বিস্ফোরন হয় এবং সমুদ্রের পাঁচ কিলোমিটার গভীরে চলে যায়। এই ঘটনায় সাবমেরিনে থাকা সমস্ত সদস্যেরই মৃত্যু হয়। তবে এই বিস্ফোরনের কারন আজও জানা যায়নি।
সাবমেরিনটিতে তিনটি ব্যালেস্টিক মিসাইল ছিল যার প্রতিটিতে তিন মেগাটনের পরমানু অস্ত্র ছিল। সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে এটি সবসময় মোতায়েন থাকতো।
কে-১২৯ কে ন্যাটো গল্ফ ২ ক্লাস সাবমেরিন বলতো। প্রজেক্ট ৬২৯ এর আওতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এধরনের মোট ছয়টি সাবমেরিন তৈরি করেছিল। কে-১২৯ একটি ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিন যা স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। ১৯৫৪ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সাবমেরিন গুলো তৈরির কাজ শুরু করে এবং ১৯৫৯ সালে পুরো প্রজেক্ট সম্পন্ন হয়। ২৭৪৩ টন ডিসপ্লেসমেন্ট যুক্ত এই সাবমেরিনটি ১০০ মিটার লম্বা। এতে তিনটি ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছিল যার প্রতিটি ১৫০০ কিলোওয়াট ক্ষমতা উৎপন্ন করতে সক্ষম। কে-১২৯ এর সর্বোচ্চ গতি ১২-১৪ নট বা ২২-২৬ কিলোমিটার। ১৬৬ জন সদস্য সহ এই সাবমেরিনটি সমুদ্রে ৭০ দিন পর্যন্ত থাকতে পারত। এই সাবমেরিনটি তিনটি আর-২১ ব্যালেস্টিক মিসাইল বহন করত। আর-২১ ছিল প্রথম সোভিয়েত ব্যালেস্টিক মিসাইল যা সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপন করা সম্ভব ছিল। আর-২১ এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১৩০০ কিলোমিটার। আমুর শিপইয়ার্ডে তৈরি হওয়া কে-১২৯, ১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। এই সাবমেরিনটি ডুবে যাবার পর সোভিয়েত ইউনিয়নও অনেক খুঁজেছিল কিন্তু তারা খুঁজে পায়নি, কারন তারা সাবমেরিন ডুবে যাবার সঠিক অবস্থান বুঝতে পারে নি কিন্ত আমেরিকা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু আমেরিকানরাও এর প্রকৃত কারন বুঝতে পারেনি।
আমেরিকার ইউএসএস হেলবাট নামে একটি পরমানু সাবমেরিন ১৯৬৮ সালের ২০ আগস্ট এই সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে কুড়ি হাজারের বেশী ছবি তুলে, সঠিক অবস্থান সম্পর্কে সিআইএকে জানায়। প্রকৃত কারন জানা না গেলেও কে-১২৯ বিস্ফোরনের জন্য বেশ কয়েকটি কারনকে বিবেচনা করা হয়। প্রথমত ব্যাটারি চার্জের সময় হাইড্রোজেন বিস্ফোরন, দ্বিতীয়ত ইউএসএস সোয়ার্ডফিস নামে একটি পরমানু সাবমেরিনের সাথে ধাক্কা, তৃতীয়ত সাবমেরিনের ভিতরেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে মিসাইলের বিস্ফোরন। সাবমেরিনটি ধ্বংস হবার সময় এটায় ১৩৮ জন সদস্য ছিল যারা প্রত্যেকেই মারা যায়। সিআইএ এই সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করে কারন রাশিয়ান আধুনিক সাবমেরিন টেকনোলজি, পরমানু অস্ত্র ও উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থার প্রযুক্তির জন্য এই সাবমেরিন উদ্ধারের পরিকল্পনা শুরু করে সিআইএ। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ১৯৬৯ সালে সিআইএকে এই সাবমেরিন উদ্ধারের নির্দেশ দেয়। সিআইএ একটি বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ান।
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চেষ্টা করে ১৯৭৪ সালের ৮ আগস্ট সমুদ্রের তলা থেকে ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে। সফল হয় প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ান, মোট ৮০০ মিলিয়ন ডলার বা আজকের হিসাবে চার বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল এই প্রজেক্টে। কিন্তু সিআইএর এত চেষ্টা সত্বেও এই গোপন খবর একবছর পর ১৯৭৫ সালের মার্চে নিউইয়র্ক টাইমস ও লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসে এই খবর প্রকাশ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমেরিকার সরকার ও সিআইএ কখনও প্রকাশ্যে এই প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ানের কথা স্বীকার করেনি এবং এতে কী পাওয়া গিয়েছিল তাও গোপন রাখা হয়েছে আজ পর্যন্ত।