বিশ্বায়নের দশকেও পিছিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশ! দুর্বল ইতিহাস নিয়ে লড়াইয়ের মাঠে আফ্রিকা

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

ইতিহাসের পাতা উল্টে অতীতে ফিরে গেলে  দেখা যায় প্রতি শতাব্দীতেই কোন না কোনও শক্তির অভ্যুত্থান ঘটেছে যাদের প্রভাব ছিল গোটা বিশ্বে । যেমন সপ্তম, অষ্টম শতাব্দীতে ইউরোপীয়ানরা এশিয়া, আফ্রিকা জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। বিশেষত ব্রিটিশরা ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী৷  বিংশ শতকে বিশ্বে আমেরিকার প্রভাব শুরু হয়েছিল। 

বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার একচ্ছত্র প্রভাবের জায়গায় বিভিন্ন শক্তিশালী দেশের উত্থান ঘটেছে,  এশিয়ার দুটি বিশাল শক্তি চীন ও ভারতের উত্থান হয়েছে। 

কিন্ত বিশ্বে এমন একটি মহাদেশ আছে যা আজও অনুন্নত, যারা বাকী বিশ্বের থেকে  পিছিয়ে আছে বহু শতক পেছনে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ আফ্রিকার পরিস্থিতি সেরকমই। এই মহাদেশের  বেশীরভাগ দেশই  অনুন্নত এবং দারিদ্র্য সীমার নীচে । ইউরোপীয়ানদের থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার বহু বছর পরেও আফ্রিকা মহাদেশের অগ্রগতি হয়নি আজও। 

আফ্রিকা মহাদেশে সোনা, তেল, ইউরেনিয়াম, লোহা, কোল্টান, বক্সাইটের মতোন ধাতব সম্পদ প্রচুর পরিমানে রয়েছে। কিন্তু এসব প্রাকৃতিক সম্পদ সাধারন আফ্রিকা বাসীর জীবনযাপনের মান উন্নত করতে পারেনি। ইউরোপীয়ানদের থেকে আফ্রিকার মুক্ত হবার পর প্রায় পাঁচ দশক কেটে গেছে তাও আফ্রিকার তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। যদিও মিশর, দক্ষিন আফ্রিকা, নাইজেরিয়ার মতোন আফ্রিকান দেশ গুলোর অবস্থা তুলনামূলক ভাবে যথেষ্ট ভালো তবুও পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব দেশ বুরুন্ডি আফ্রিকাতেই রয়েছে। 

 তাহলে বিশ্বায়নের এই দশকে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের তুলনায় আফ্রিকা কেন  পিছিয়ে আছে এতটা

আফ্রিকা মহাদেশের এই অবস্থার পেছনে তাদের ইতিহাসের ভূমিকা রয়েছে। চোদ্দশ শতকের দিকে পর্তুগীজরা আফ্রিকান ক্রীতদাসদের সাও টোমোতে তাদের চিনির কারখানায় কাজ করাতো।  সেই থেকেই আফ্রিকার উপর ইউরোপের উপনিবেশের সূত্রপাত হয়। বহুজাতিক সংস্থা গুলোর দ্বারা আফ্রিকার অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে বেশী হয়েছিল। ২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী যে পরিমান  সাহায্য আফ্রিকায় এসেছে, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গুলো দ্বারা তার থেকে তিনগুন বেশী পরিমান অর্থ বেরিয়ে গেছে। এই মহাদেশের কথা উঠলেই প্রথমেই মাথায় আসে দুর্নীতি, গরীবি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা। ১৮৮৪-৮৫ বার্লিন সম্মেলনে ইউরোপীয়ানরা আফ্রিকার সংস্কৃতি না বুঝেই আফ্রিকাকে নিজেদের মনের মতো ভাগ করে দেয়। ফলে আফ্রিকার অনেক উপজাতি সম্প্রদায় আলাদা হয়ে যায় এবং অনেক সম্প্রদায় একত্রে থাকতে বাধ্য হয়। যার ফলে আফ্রিকার বহু দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় এবং গনতন্ত্র বিরোধী শাসন শুরু হয়। আফ্রিকার এমন অনেক দেশ আছে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, তুলনামূলক তারা উন্নতও কিন্ত যেটা সবচেয়ে সমস্যার তা হচ্ছে এসব দেশে গনতন্ত্র মডেল যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন দক্ষিন সুদান নামে একটি আফ্রিকান দেশ পূর্ব আফ্রিকান জোটের অংশ হওয়া সত্বেও দেশটিতে সুষ্ঠ নির্বাচন হয়না। তেলে ভরপুর এই দেশটি দীর্ঘ আন্দোলনের পর ২০১১ সালে সুদান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হয়। কিন্তু এর দুবছর পরই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। মূলত দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। একটি দল রাষ্ট্রপতি সালভা কিরের সমর্থক ছিল এবং অন্যদল প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রিক মাচেরের সমর্থক ছিল। ২০২৩ এ দক্ষিন সুদানে গনভোট হবার কথা ছিল কিন্তু সালভা কির এই নির্বাচন আরও দুই বছর পিছিয়ে দিয়েছে, ফলত ২০২৫ এর আগে নির্বাচনের কোনও সম্ভবনা নেই। 

 আফ্রিকার বেশীরভাগ দেশের রাজনৈতিক অবস্থার এমনই চিত্র। এখানে রাজনৈতিক সংকট তীব্র হিংসার রূপ নেয়। যেমন আফ্রিকার একটি দেশ নাইজেরিয়া ২০১১ থেকেই বোকো হারাম নামে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সাথে লড়াই করছে। এই সংগঠন প্রায় বারো বছর ধরে নাইজেরিয়ায় সন্ত্রাসবাদী কাজ চালাচ্ছে। বহু সাধারন মানুষের মৃত্যু হয়েছে বোকো হারামের দ্বারা। ১৯৬০ সালে স্বাধীন হবার পর দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের পর অবশেষে ১৯৯৯ সালে নাইজেরিয়ায় প্রথম গনভোট হয়। কিন্তু নির্বাচিত দুর্বল সরকার এবং দূর্নীতির কারনে দেশটির আভ্যন্তরীন অবস্থা শোচনীয়। বিশ্বের অন্যতম দূর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসাবে ১৮০ টি দেশের তালিকায় নাইজেরিয়ার অবস্থান ১৫৪ তে। বোকো হারামের থেকে অনুপ্রানিত আরও বেশ কিছু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তৈরি হয়েছে নাইজেরিয়াতে।

 যখন কোন দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয় তখন তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থার উপর। যে কোনও দেশকে অর্থনৈতিক ভাবে মজবুত হতে গেলে সঠিক শিক্ষাব্যাবস্থার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু তথ্য অনুযায়ী শুধু সাহারা অঞ্চলেই ৩৩ মিলিয়ন বাচ্চা বিদ্যালয়ে যায় না যার মধ্যে ১৮ মিলিয়নই মেয়ে। তবে বিগত কয়েক বছরে আফ্রিকার শিক্ষার হার কিছুটা বাড়লেও পচিশ বছরের উপর পঞ্চাশ শতাংশ আফ্রিকান মহিলা শিক্ষিত নয় এখনও। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ তে মালিতে সন্ত্রাসবাদী দের দ্বারা অনেক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে প্রায় আড়াই লাখ বাচ্চার শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বোকো হারাম সহ সমস্ত সন্ত্রাসী সংগঠন গুলো প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে ধ্বংস করে। এর ফলে বাচ্চারা শিক্ষা পায়না এবং তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষন দেওয়া হয় এবং সন্ত্রাস চলতেই থাকে। যার কারনে আফ্রিকাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে, এই কারনে দেশ গুলোতে শিল্প প্রতিষ্ঠান তেমন নেই। আফ্রিকার সমস্ত শিল্প উৎপাদনের দুই তৃতীয়াংশ মাত্র পাঁচটি দেশ মিশর, দক্ষিন আফ্রিকা, মরোক্ক, নাইজেরিয়া ও আলজেরিয়ায় সীমাবদ্ধ। তার উপর করোনা মহামারী, মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবেও আরও ক্ষতিগ্রস্ত আফ্রিকার অর্থনীতি। রেল নেটওয়ার্ক, পানীয় জল, বিদ্যুৎ ব্যাবস্থা এবং রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রে আফ্রিকা বাকী বিশ্বের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। যেখানে বাকী বিশ্ব মহাকাশ, চাঁদ, মঙ্গলে পৌঁছে গেছে সেখানে আফ্রিকা তাদের ভঙ্গুর অর্থনীতির শিকার। 

এছাড়া বর্তমানে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সমস্যা নিও কলোনাইজেশন। আফ্রিকা ইউরোপীয়ান উপনিবেশ থেকে বহু আগেই মুক্ত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বিদেশি শক্তিগুলো তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা আফ্রিকান দেশ গুলোর উপর খাটাচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহারন চীন। আমেরিকাকে সরিয়ে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক সঙ্গী হচ্ছে চীন। প্রথম দিকে ইথিওপিয়া ও কেনিয়া চীনের বিআরআই বা বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টে সই করেছিল কিন্তু বর্তমানে প্রায় গোটা আফ্রিকা জুড়ে চীনের প্রজেক্ট রয়েছে। চীন ইচ্ছে করেই আফ্রিকান দেশ গুলোকে প্রচুর লোন দেয়, চীন জানে আফ্রিকান দেশ গুলো শোধ করতে পারবে না এই ব্যাপক অর্থ তখন চীন সেই দেশের উপর প্রভাব খাটায় ও তার জমি লিজ নিয়ে নেয়, একে ডেব্ট ট্রাপ নীতি বলা হয়। শ্রীলঙ্কা এর সবচেয়ে বড় উদাহারন।

#Source: online/Digital/Social Media News # Representative Image

Journalist Name : Ashapurna Das Adhikary

Related News