বেশ কয়েকদিন ধরেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে 'পিপ্পা' সিনেমা । কাজী নজরুল ইসলামের 'কারার ওই লৌহ কপাট'গানটির সুর বিকৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ । প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সর্বত্র ।
বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি খিলখিল কাজী ও নাতি কাজী অরিন্দম। নজরুলের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটিকে হিন্দি ছবি ‘পিপ্পা’য় এ আর রহমান নিজের কায়দায় ব্যবহার করে বাংলা ও বাঙালির অপমান করেছেন, এই অভিযোগে সম্প্রতি তোলপাড় চলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
পরিবারের ভুলেই এত সমস্যা নজরুলের গানকে ঘিরে? এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের নাতি কাজী অরিন্দমের সাফ কথা, “আমরা আইনি পদক্ষেপ করব কাজী অনির্বাণের বিরুদ্ধে। চিঠি পাঠাব পিপ্পা-টিমকে। এই কাজটি করার আগে ওঁদের অন্তত দু’বার ভাবা উচিত ছিল। গানটার কেস হিস্ট্রি পড়া দরকার ছিল।” কাজী অরিন্দমের সংযোজন, “এটা তো শুধু একটা গান নয়, এটা একটা আন্দোলন, ইতিহাস, সংগ্রাম, যার সঙ্গে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনও জড়িয়ে আছে। তাই আমি চাইব এটা ওঁরা ওখান থেকে প্রত্যাহার করুন। ছবিতে গানের আসল সুরটি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কাজী অনির্বাণ গর্হিত কাজ করেছেন। আমরা তাঁর শাস্তির দাবি করছি। রাজ্য সরকারের কাছেও এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানব।”
রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত ‘পিপ্পা’ সিনেমা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। তার চেয়ে বেশি গলা চড়েছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সংগীতায়োজন নিয়ে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে, কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে মামলা ও বয়কটের কথাও বলেন। সোমবার ১৩ নভেম্বর সেই বিতর্ক ঘিরে বিবৃতি দিয়েছিলেন ‘পিপ্পা’ ছবির অন্যতম প্রযোজক সিদ্ধার্থ রয় কাপুর।
এব্যাপারে আগেই মিডিয়েকে কাজী অনির্বাণ বলেছেন
“এই চুক্তি সই করার সময় আমার মা কল্যাণী কাজী ভেবেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের গানটিকে আরও সুন্দর করে গেয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কারণ রহমান সাহেব আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষ। সেই সরল বিশ্বাসেই কিন্তু আমার মা চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন। আমি সাক্ষী হয়েছিলাম। আমরা কিন্তু এটা কখনওই বুঝিনি কিংবা আমাদের বোঝানো হয়নি গানের কথাগুলোই পাল্টে ফেলবেন রহমান। কিংবা তিনি সুর পাল্টে ফেলবেন। তারপর আমাদের একবারও শোনানোও হয়নি গানটা। কী করা হল কালজয়ী কম্পোজ়িশন নিয়ে, জানতেই পারলাম না। ২০২১ সালে গানের চুক্তিপত্র হল। আমার মা কল্যাণী কাজী তখন জীবিত (২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি প্রয়াত হয়েছেন)।” সাংবাদিক সম্মেলনে কাজী অরিন্দম বলেছেন, “টাকা-পয়সা না দিলে গান গাইতে দেব না আমরা, এরকম একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। কারণ এটা দাদুর প্রতি একটা সাম্মানিক অর্থ। এই টাকা দিয়ে আমরা ঘর-বাড়ি করি না। এই সাম্মানিকটুকু না-দিলে দাদুর প্রতি অমর্যাদা হবে।” এর পর খিলখিল কাজীর সুরেই কথা বলতে শোনা যায় কাজী অরিন্দমকে, “যেহেতু আগামী ১০-১৫ বছর কপিরাইটের ব্যাপারটা থাকবে, তাই এরকমই চলবে। তার মধ্যে সরকারকে বলে একটা বোর্ড গঠন করতে পারি। তাহলে কপিরাইট উঠে গেলেও সেই বোর্ড নজরুলের গানগুলি সংরক্ষণের চেষ্টা করতে পারে।”
রয় কাপুর ফিল্মসের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। সেখানে লেখা হয়, ‘এই গানকে ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেখানে প্রযোজক, পরিচালক এবং সংগীত পরিচালক হিসেবে আমরা নজরুল পরিবারের থেকে প্রয়োজনীয় স্বত্ব নেওয়ার পরই শিল্পের খাতিরে গানটি তৈরি করেছি।’
‘কাজী নজরুল ইসলাম ও তার সৃষ্টির প্রতি আমাদের মনে গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে’ উল্লেখ করে জানানো হয়, নজরুলের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী ও তার ছেলে কাজী অনির্বাণের থেকে যাবতীয় নিয়ম মেনে যে এই গানের স্বত্ব নেয়া হয়েছিল।
এর আগে নজরুল পরিবারের তরফে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বলা হয়েছিল, গানের কথা ব্যবহার করা হলেও সুর বদলানো যাবে না এই মর্মেই তারা নির্মাতাদের স্বত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিবৃতিতে রায় কাপুর ফিল্মস জানিয়েছে, ‘গানটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে শ্রদ্ধা জানানোই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। গানের কথা ব্যবহার ও সুরের পরিবর্তন চুক্তি অনুযায়ী করা হয়েছে।’
সব শেষে বলা হয়েছে, ‘আমরা মূল গানটিকে ঘিরে শ্রোতাদের আবেগকে সম্মান করি। শিল্প যেহেতু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে আমাদের পদক্ষেপ যদি কারও আবেগে আঘাত করে থাকে, তার জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’
অবশ্য এ গান নিয়ে সব নিন্দা সইতে হচ্ছে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক এ আর রহমানকে।
কারার ঐ লৌহ কপাট | Karar Oi Louho Kopat
কথা ও সুর: কাজী নজরুল ইসলাম
কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত জমাট শিকল পুজোর পাষাণ বেদী
ওরে ও তরুণ ঈষাণ
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান উক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি ॥
ওরে ও পাগলা ভোলা
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা জোরসে ধরে হ্যাচকা টানে
মার হাঁক হায়দরী হাঁক
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক মৃত্যুকে ডাক
জীবন পানে ॥
গাজনের বাজনা বাজা
কে মালিক কে সে রাজা
কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে
হা হা হা পায় যে হাসি
ভগবান পরবে ফাঁসি সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে ॥
নাচে ঐ কাল বোশেখী
কাটাবি কাল বোসে কী
দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি
লাথি মার ভাঙ রে তালা
যত সব বন্দীশালায়
আগুন জ্বালা আাগুন জ্বালা
ফেল উপাড়ি ॥