সময়টি ১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভাগ হলো। ভাগ হলো বাংলা। ভাগ হলো পাঞ্জাব। ভাগ হলো ভারতবর্ষ। এই দেশভাগের পৌনে এক শতাব্দী হলো এ বছরের আগস্ট মাসে। কালের বিচারে পঁচাত্তর বছর সময়টি খুব বেশি নয়। আবার খুব কম, এমনটাও বলা যাবে না। দেশভাগের ফলাফল হিসেবে প্রথম পর্যায়ে দুটি দেশ—ভারত ও পাকিস্তান। পরে দেশভাগের ভিত্তি দ্বিজাতিতত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখার প্রয়োজনীয়তা ও প্রত্যয় থেকেই বাংলাদেশের জন্ম। তবে বাংলাদেশ ও গোটা উপমহাদেশ কী ধর্মান্ধতার সেই নেতিবাচক প্রভাব থেকে কি বেরোতে পেড়েছে? দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেশভাগ আমাদের সামনে সে প্রশ্ন নতুন করে জাগ্রত করে। ভারত-পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ প্রকাশ্য উপস্থিত। যা আজ আপনার-আমার জীবনের প্রতিদিনকার ঘটনা। এই অঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনকার ঘটনা ও লড়াই।
দেশভাগ এই উপমহাদেশজুড়ে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে যায়। যার ক্ষত ও প্রভাব দৃশ্যমান—রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য, সাংস্কৃতিকসহ সকল পরিমণ্ডলে। দেশভাগের পরিসর, পরিমণ্ডল ও পাত্রপাত্রীদের বোঝার ক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটকের [১৯২৫-১৯৭৬] চলচ্চিত্র আমার কাছে একটি মানবিক ও সর্বজনীন দর্পণ। ঋত্বিক ঘটক বাংলা চলচ্চিত্রে প্রবাদপ্রতিম চরিত্র। ঋত্বিক ঘটক আদিতে পূর্ববঙ্গের সন্তান। সেই সাথে প্রকাশ্য ঘটকের চলচ্চিত্রের প্রতি আমার বিশেষ ভালো লাগার বিষয়টি জানাতে আমি পছন্দ করি। বিশেষত তাঁর রাজনৈতিক দার্শনিকতার জন্য। ঘটকের রাজনৈতিক দর্শন ও দেশীয় ভাবনার আঁধার, আমার আকর্ষিত হবার মূল কারণ। আর ঘটকের চলচ্চিত্র প্রয়াসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে দেশভাগ, দেশত্যাগের এবং চল্লিশ-পঞ্চাশের এক কঠিন ইতিহাস। ঘটকের চলচ্চিত্র তাঁর জীবনসংগ্রাম ও সময়ের গভীর দাগ, ক্ষত ও সর্বোপরি তাঁর শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশ ও বিকাশ। এ প্রবন্ধে ঋত্বিকের চোখে দেশভাগের ব্যাপ্তি ও গভীরতাকে বোঝার প্রচেষ্টা থাকবে।
শুধু বাংলা বা ভারত নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে দুজন প্রধান ব্যক্তিত্ত্ব ভারতীয় তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন, ঘটক সেখানেই অন্যতম ও অনন্য। ঘটক সারা জীবন দেশভাগকে গভীর মানবিকতা ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখেছেন। দেশভাগকে ঋত্বিক সংস্কৃতির ভাগ হিসেবে দেখেছেন। বস্তুত ঋত্বিক সেই বিরল স্রষ্টাদের অন্যতম, যাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রতিনিয়ত আবিষ্কারের সুযোগ রয়েছে নতুন নতুন সব ভূখণ্ড। ‘দেশভাগ’ তাঁর কাছে গভীর এক মর্মবেদনা আর যন্ত্রণার কারণ ছিল। তাই দেশভাগের মর্মযন্ত্রণা আর বামপন্থী মতাদর্শের বিশ্বাসের ছায়া তাঁর প্রতিটি ছবিতে রেখে গেছেন, যা ইতিহাসে মানবসৃষ্ট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়। আর ঋত্বিকের দেশভাগের ওপর নির্মিত ছবিগুলো সময়ের এক সামাজিক দলিল।
বাংলা সিনেমা স্বর্ণ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’ দ্বারা চলচ্চিত্রের তাঁর আবির্ভাব। কিন্তু আর্থিক কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় “অযান্ত্রিক” যেখানে একটি যন্ত্র ও তার মালিকের অদ্ভুত মানবিক সম্পর্ক বন্ধনে চিত্র ধরা পড়ে। দেশভাগের পটভূমিকাতে তার ছবি “কোমল গান্ধার”, বাস্তুহারাদের নিয়ে তার দুর্ধর্ষ দুটি ছবি “মেঘে ঢাকা তারা” ও “সুবর্ণরেখা”।
পূর্ববঙ্গের জেলেদের জীবন কাহিনী নিয়ে তার ছবি “তিতাস একটি নদীর নাম”। সমকালীন বিতর্কিত রাজনীতি ছবি হল “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো” এটি তাঁর শেষ ছবি। সংখ্যায় খুবই অল্প তার পরিচালিত ছবি তালিকা, কিন্তু প্রতিটি ছবি শিল্প নিষ্ঠুর এক নতুনত্বের সন্ধানী। আবেগে, মননে, সংলাপে, দৃশ্যের সংঘর্ষ নির্মাণে তাঁর সিনেমা সম্পূর্ণ অভিনব। তিনি মাঝে মাঝে সিনেমার দৃশ্যের সাহায্যে এমন এমন কাব্য মুহূর্তে তৈরি করেন যা দর্শকের মন কে নাড়িয়ে দেয়। তার সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছেন- “ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক, বাঙালি শিল্পী, আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে এটাই তাঁর সবথেকে বড় পরিচয়। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার “রজতকমল” ছাড়াও “পদ্মশ্রী” পুরস্কারে সম্মানিত হন।