হাসির রাজা জ্ঞানের রাজা রসিক রাজা চিন্ময় রায়

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

১৯৪০ সালের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কাশীপুর ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন ১৯৫৯ সালে। চাকরি করেছেন দিল্লির একটি প্রকাশন সংস্থায়। কিন্তু নাটক পাগল মানুষ ছিলেন চিন্ময় রায়। গ্রুপ থিয়েটার করতেন। নান্দীকার গোষ্ঠীর ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ নাটকে তাঁর অভিনয় অনেকের মনেই দাগ কাটে। বিশেষত যেখানে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো ডাকসাইটে শিল্পীরা রয়েছেন; সেখানে দর্শকদের নজর কাড়লেন চিন্ময়। নজরে পড়লেন পরিচালক তপন সিংহের। ১৯৬৬ সালে নির্মীয়মাণ ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্র চিন্ময় রায়কে (Chinmoy Roy) সুযোগ দিলেন তপন সিংহ। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধাগ্রস্ত হননি চিন্ময় রায়। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯৭৫ সালে। এই শিল্পী দম্পতির এক পুত্র, এক কন্যা। বাংলা ফিল্ম দুনিয়ায় সত্তরের দশকে পা রাখেন তিনি। অচিরেই সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠেন। চিন্ময় রায়ের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল কলকাতার থিয়েটার মঞ্চ থেকে। প্রথমে থিয়েটার ও নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হন। নান্দীকারের সাথে যুক্ত থাকার পরে ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন নাট্য ওয়ার্কশপ। তারপর সিনেমাতে দাপিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। মূলত কৌতুক চরিত্রে তার অভিনয়ের জন্য বৃহৎ পরিচিতি লাভ করেন তিনি।

তপন সিংহের গল্প হলেও সত্যি দিয়ে শুরু করে সবার নজর কাড়েন চিন্ময় রায়। এরপর মৌচাক, হাটেবাজারে, ওগো বধূ সুন্দরী, বসন্ত বিলাপ, গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর মতো অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন। টেনিদা চরিত্রে চারমূর্তি সিনেমায় তার অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে তাকে অধিক জনপ্রিয় করে। ভারতের বাংলা সিনেমার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। বহু সিনেমায় তার কমেডি চরিত্রে অভিনয় আজও মনে রেখেছেন মানুষ। বড় পর্দায় ‘চার মূর্তি’ বিশেষ উল্লখযোগ্য। এই ছায়াছবিতে তিনি সাহিত্যিক নারায়ান গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্ট টেনিদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ব্যবসায়িক সিনেমায় কমেডিয়ান হিসেবে চিন্ময় রায়ের নামডাকের আড়ালে তাঁর নাটকের সত্তা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। নান্দীকারের সদস্য হিসেবে শুরু করেছিলেন অভিনয় জীবন। পরে ১৯ জন মিলে সে দল ছেড়ে গড়ে তোলেন ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’। চিন্ময় রায়ও ছিলেন সেই ১৯-এর একজন। থিয়েটার ওয়ার্কশপের হয়ে নাটক পরিচালনাও করেছেন। সেসব দিনের কথা চিন্ময় রায়ের অভিনয় প্রতিভার কথা তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন বিভাসবাবু। লেখাটি বেরিয়েছে ‘চৌরঙ্গী’ সাহিত্য সংস্কৃতি পত্রিকার চিন্ময় রায় সংখ্যায়। শুধু বিভাস চক্রবর্তীই নন। নট চিন্ময় রায়ের কথা লিখেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তও। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নাটক করার খিদেটা বেঁচে ছিল চিন্ময় রায়ের মধ্যে। সে কথা জানিয়েছেন আর এক গুণি নট ও সিনেমার তথাকথিত কমেডিয়ান শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। শুভাশিসবাবুকে চিন্ময় রায় মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘চ, তোতে আমাতে মিলে একটা নাটকের দল গড়ে অভিনয় করি’। যদিও তা আর হয়ে ওঠেনি। চিন্ময় যখন একজন জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে উঠছে তখন বাংলা চলচ্চিত্রে রাজ করছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার এবং রবি ঘোষ।তাঁদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন। কিন্তু আজ এঁরা কেউ নেই। হাসির নামে যা হচ্ছে তা লোক হাসানো ব্যাপার ছাড়া কিছু নয়। এই পরিস্থিতির শিকার একসময় হয়েছিলেন চিন্ময়ও। এমন বহু ছবিতে তিনি কাজ করেছেন যেখানে অভিনয় দেখানোর সুযোগ নেই। তবু টিকে থাকার জন্য অভিনয় তো করতেই হবে। মনের শান্তি পেতে চিন্ময় রায় কখনও যাত্রায় গেছেন কখনও বা দূরদর্শন ধারাবাহিকে। তিনি নিজে একটি ছবি পরিচালনাও করেছিলেন। ‘চারমূর্তি’ ছবির রিমেক। সেখানে টেনিদার ভূমিকায় তিনি নিয়েছিলেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে। ছবিটি একদম চলেনি। তখনও পূর্ণ গৌরব নিয়ে বিরাজ করছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, হরিধন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। চিন্ময় কোনও এক লেখায় বলেছিল রবি ঘোষই নাকি ওকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন। হয়তো তাই। কিন্তু আমি মনে করি, ‘নান্দীকার’-এ থাকাকালীন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন শিক্ষককে পেয়েছিল বলে চিন্ময় শুধুমাত্র একজন চুটকি-নির্ভর কমেডিয়ান হয়ে ওঠেনি, সত্যিকারের এক জাত অভিনেতার গুণগুলি অর্জন করতে পেরেছিল।

চিন্ময় রায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তাঁর স্ত্রী জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গিয়েছিলেন। তিনি একাকিত্বে ভুগছিলেন। নাটকও তেমন জমাতে পারছিলেন না। শেষে একদিন তাঁর নিজের ফ্ল্যাট বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে অচৈতন্য অবস্থায় উপর থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রায় এক বছর তিনি ভুগলেন। শেষে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ রাত ১০:৪৫ মিনিটে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। ননীগোপালের বিয়ে, চারমূর্তি, বসন্ত বিলাপ, ধন্যি মেয়ে প্রভৃতি ছবির মধ্য দিয়ে তিনি অনন্য কৌতুকাভিনেতা হিসেবে আমাদের মনের মধ্যে স্থান করে রেখেছেন।

#Source: online/Digital/Social Media News # Representative Image

Journalist Name : Aparna Dutta

Tags:

Related News