অবলুপ্তির পথে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী হাতে টানা রিকশা

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk :

শহর কলকাতা। এক ঐতিহ্যবাহী শহর। দেশের পুরনো রাজধানী। পুরনো জিনিস যেভাবে আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। সেরকমভাবেই নিজেকে আঁকড়ে বেঁচে থাকে কিছু কিছু জিনিস। যার মধ্যে শুধু বেঁচে আছে কলকাতার ঐতিহ্যরা। যেমন ট্রাম, যেমন হলুদ ট্যাক্সি, হাতে টানা রিক্সা। উত্তর কলকাতার অলি-গলি কিংবা রাজপথে বেড়োলেই চোখে পড়বে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এই টানা রিক্সা। কানে বেজে উঠবে ঠুং ঠুং আওয়াজ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কতশত গল্প। বিদেশি পর্যটকেরা এখনো কলকাতায় এলে শখ করে হাতে টানা রিকশায় চড়েন। অথবা একটু বয়স্ক লোকজনও তাঁদের সময়কে মনে করে উঠে বসেন টানা রিকশায়। এটি যেন সেই শান আর শওকতের জন্যই। কিন্তু এই যান কি এবার হারিয়ে যাবে? প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে কলকাতার আনাচ-কানাচে। এইগুলিই তো এক সময় কলকাতার শান-শওকতের প্রতীক ছিল । আর আজ হয়তো বেশ খানিকটা খোঁজাখুঁজি করলে উত্তর কলকাতার অলিতে গলিতে হাতে টানা রিক্সা দেখতে পাবেন আপনি। ভাগ্য সঙ্গ দিলে রাজপথেও দু-একটা কাঠের তৈরি হাতে টানা রিক্সার দেখা মিলতে পারে। এই কাঠের টানা রিক্সা গুলি এখনও একেবারে শহর থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তাই মাঝে মধ্যেই বয়স্ক নাগরিকরা তাদের সময়ের কথা মনে করতে টানা রিক্সায় চড়ে বসেন। আবার বিদেশ থেকে কোন পর্যটকেরা কলকাতায় এলে শখ করে হাতে টানা রিকশায় চড়েন। কিন্তু এই মন্দার বাজারে হাতে টানা রিক্সা চালকদের টিকে থাকা বড় দায়। অনেকেই এমন রয়েছেন যারা টানা রিক্সার পাঠ চুকিয়ে অন্য কোথাও কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। কটা মানুষই বা টানা রিক্সা ব্যবহার করেন ? দিনশেষে তো সেই টানা রিক্সার চালকদেরও প্রয়োজন টাকাই । কতদিন আর শহরের ঐতিহ্য নিজেদের ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াবেন তাঁরা ? কলকাতায় প্রথম কবে টানা রিক্সার প্রচলন শুরু হয়েছিল জানেন ? এর সঙ্গে কলকাতার ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে ওতোপ্রোতভাবে। সালটা তখন ১৮৮০। সেই সময় ভারতবর্ষে প্রথম রিক্সার আগমন ঘটেছিল। এই রিক্সা নামক যানটি তো সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়েছিল জাপানে। সে দেশে এই গাড়িকে বলা হতো জিন-রিকি-শ। প্রথম কিন্তু কলকাতায় রিক্সা যাত্রী বহন করার জন্য চালু হয়নি। সেই সময় বড়বাজার এলাকায় বহু চিনা বসবাস করতেন। তাঁরা বেশির ভাগই কলকাতা আর খিদিরপুর ডকে খালাসির কাজ করতেন।

নিজেদের সুবিধার জন্যই মাল ওঠাতে নামাতে এই রিক্সার ব্যবহার শুরু করলেন তাঁরা। মাঝেমধ্যে কখনও রাস্তায় যাত্রীদেরকেও গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন। এইভাবেই কলকাতার রাজপথে টানা রিক্সার প্রচলন শুরু হয়। কলকাতার বাইরে কিন্তু সেই ভাবে হাতে টানা রিক্সার খুব একটা প্রচলন ছিল না। তবে একটি ছবি যা ইতিহাসের সাক্ষী বটে, সেখানে টানা রিক্সা দেখা যায় ১৯০৫ সালে। জায়গাটি ছিল বর্ধমানের কার্জন গেট। এর বহুবছর পর ১৯১৯ সালে কলকাতার রাস্তায় পাকাপাকিভাবে হাতে টানা রিক্সায় যাত্রী বহন করা শুরু হল। শুধুমাত্র বাঙালিরা নন বহু বিহারী শ্রমিকরা এই টানা রিক্সাকে নিজেদের পেশা হিসেবে বেছে নিলেন। তাতে তাদের আয় মন্দ হতো না। যদিও সরকার ভাড়া বেঁধে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কলকাতায় হাতে টানা রিক্সা তুলে দিয়ে ব্যাটারি বা জ্বালানি চালিত স্কুটার রিক্সার প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রিক্সা চালকরা। তাঁরা নেমেছিলেন আন্দোলনে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে কলকাতার ৭ হাজার হাতে টানা রিকশাচালক ও তাঁদের পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করার জন্য তাঁদের হাতে স্কুটার তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এই প্রকল্প চালু হলে সত্যিই কলকাতা থেকে বিদায় নেবে হাতে টানা রিকশা। ইতিমধ্যে শহরের অনেক রাস্তায় বন্ধ করে দিয়েছে হাতে টানা রিকশা চলাচল। তবে বিদেশি পর্যটকদের আসা-যাওয়ার এলাকা যেমন, ধর্মতলা, শিয়ালদহ, বড়বাজার এলাকায় এর চলাচল রয়েছে, যাতে বিদেশি পর্যটকেরা কলকাতায় এসে একবার চড়তে পারেন হাতে টানা রিকশায়। এরপর বহু বছর হাতে টানা রিক্সা শহরের রাজপথে চলেছে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শহরে এই হাতে টানা রিক্সার সংখ্যা চাইলে গুনে বলা যেতে পারে। তবে ধর্মতলা, শিয়ালদা, বড়বাজার এই এলাকা গুলিতে যেহেতু বিদেশি পর্যটকদের আসা যাওয়া থাকে, সেই কারণে খুঁজলে এখানে হাতে টানা রিক্সা মিলতে পারে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হয়তো এই রিক্সা গুলিও হারিয়ে যাবে, এদের গল্প বলবে ইতিহাসের পাতা। প্রিয় কলকাতার অনেক মানুষই চান না, শহর থেকে এই হাতে টানা রিকশা বা ট্রাম উঠে যাক। মন্দার বাজারে ধুঁকে ধুঁকে চলা টানা রিকশা চলুক তার মতো। যদি উন্নয়নের খাতিরে এবং আধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাবে তুলেই দিতে হয়, তবে অন্তত দু-একটি রাস্তায় রাখা হোক এই দুটি যানকে ঐতিহাসিক স্মারক হিসেবে। নাহলে কলকাতার রাস্তা থেকে একটা ঐতিহ্য উঠে যাবে বরাবরের মতো। টানা রিকশার সেই টুংটাং আওয়াজ থেকে যাক একটু হলেও।


#Source: online/Digital/Social Media News # Representative Image

Journalist Name : Sampriti Gole

Related News