লিওনেল মেসিঃ এক হার না মানা রাজার রাজত্ব

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

(দ্বিতীয় পর্ব)
সালটা ২০০৭, ক্রিস্তিয়ানো রোনাল্ডো তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সম্ভাবনাময় তারকা। দিদিয়ের দ্রোগবা, কাকা, রোনাল্ডিনহো, জেরার্ড-রা তাদের ফুটবল কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসে পৌঁছেছেন। ফুটবল বিশ্ব তখন শাসন করছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। এ হেন সময়ে ঘটে গেল একটা বড় অঘটন। যে ঘটনা দিয়োগো মারাদোনা ৮৬-র ফুটবল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘটিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, সেই একই ঘটনা তারই স্বদেশীয় মাত্র ১৯ বছরের বাচ্চা ছেলে স্পেনের কোপা দেল রে'র একটি ম্যাচে পুনরাবিৃত্তি করেছে। ওইদিনের ম্যাচে সেই বাচ্চা ছেলে গেতাফের গোলকিপার সহ ৫ জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল করে নতুন ইতিহাস তৈরি করে। সেই বাচ্চা ছেলে আর কেও নয় ৭ বারের ব্যালন ডি আর জয়ী লিও মেসি।
আর্জেন্তিনার ইস্পাত কারখানার কর্মীর বাড়িতে জন্মগ্রহন করা মেসির বাবার কোচিং-এ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দলির হয়ে ফুটবল খেলায় হাতেখড়ি হয়। ৮ বছর বয়সে নিওয়েল'স ওল্ড বয়েস ক্লাবে যোগদান করেন। মেসির যোগদানের পরবর্তী ৪ বছরে ওল্ড বয়েস মাত্র একটি ম্যাচ পরাজিত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে যায় বিপত্তি। মাত্র ১১ বছর বয়সে মেসির গ্রোথ হরমোনে সমস্যা দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে ফুটবল ক্লাব রিভার প্লেট মেসির জন্য আগ্রহ দেখালেও, মেসির চিকিৎসা বাবদ ৯০০ ডলার খরচা করার মতো সামর্থ্য তাদের ছিলনা। অন্যদিকে, বার্সেলোনার তৎকালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লেস রেক্সাস লিওর খেলা দেখে এতটাই মুগ্ধ হন যে ওই মুহূর্তে রেক্সাসের কাছে কোনো কাগজ না থাকায়, মেসির বাবার সাথে ন্যাপকিন পেপারে চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং তাঁর চিকিৎসার খরচ বহন করতে সম্মত হন। মাত্র ১২ বছর বয়সে মেসি তাঁর বাবার সাথে বার্সেলোনায় চলে আসেন এবং ক্লাবের যুব দলে যোগ দেন। ২০০০ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মেসি বার্সেলোনার যুব দলে ৩০ ম্যাচ খেলে ৩৭ গোল করেন। কিন্তু এরপর অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারনে বার্সেলোনা তাকে প্রায় ছেরেই দিয়েছিল কিন্তু ক্লাব কর্তৃত্ব তাকে রেখে সেই জায়গায় সেস ফ্যাব্রেগাস -কে ছেড়ে দেয়। এরপর মাত্র ১৬ বছর বয়সে পোর্তোর বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে মূল দলে অভিষেক হলেও ২০০৩ এবং ২০০৪ সালে মেসি মুলত বার্সেলোনার সি ও বি দলের হয়ে খেলেন।
২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্সেলোনার তৃতীয় কনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে মাত্র ১৭ বছর বয়সে এস্পানিওলের বিপক্ষে লা লিগাতে অভিষেক হয় মেসির। মুলদলে অভিষিক্ত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে আলবাসেতে বালোম্পাইয়ের বিপক্ষে বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে লা লিগায় গোল করার রেকর্ড গড়েন মেসি। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্সেলোনার কর্তৃত্ব মেসির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত করেন। এরপরেই তাকে স্পেনের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ওই বছরে মেসি বার্সেলোনার হয়ে ২৩ ম্যাচে ৭ গোল করেন ঠিকই, কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলায় চেলসির বিপক্ষে তাঁর ডান উরুর পেশি ছিঁড়ে যায় এবং সেই মরসুমে তাঁর খেলা সেখানেই সমাপ্তি ঘটে। আগামী মরসুমে বেশকিছু দর্শনীয় গোলের সঙ্গে সঙ্গে মারাদোনার গোলের  ইতিহাস  পুনরাবিৃত্তি করার জন্য তাকে স্পেনের একটি সংবাদসংস্থা 'মেসিডোনা' উপাধি দেন। এই একই মরসুমে তাঁর পায়ের হাঁড় ভেঙ্গে যাওয়ায় তাকে তিনমাসের জন্য মাঠের বাইরে যেতে হয়।
২০০৮-০৯ মরসুমে বার্সেলোনা থেকে রোনাল্ডিনহো প্রস্থান করায় ১০ নম্বর জার্সি মেসি পেয়ে যান। এরপরই একই মরসুমে প্রথমে মেসি তাঁর জীবনের প্রথম হ্যাট্রিক গোল করেন, এরপর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে ৯ গোল করে লিগের ইতিহাসে এক মৌসুমে ৯ গোল করা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের অনন্য কীর্তি স্থাপন করেন। এই সময়ে বার্সেলোনা প্রথম স্পেনীয় ফুটবল ক্লাব হিসেবে  লা লিগা, কোপা দেল রে ও চ্যাম্পিয়নস লিগ তিনটি শিরোপা জিতে ট্রেবেল জয় করার কীর্তি গড়ে। মেসি উয়েফা বর্ষসেরা ক্লাব ফরোয়ার্ড ও বর্ষসেরা ক্লাব খেলোয়াড়ের পুরস্কার অর্জন করেন। পরের মরসুমে  বার্সেলোনা মেসির সঙ্গে চুক্তি বাড়িয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত করে। এই সময়ে মেসির বার্ষিক আয় ছিল ৯.৫ মিলিয়ন ইউরো। ২০০৯ থেকে ২০১২ টানা ৪ বছর মেসি ব্যালন ডি অর জয় করেন এরই সঙ্গে বার্সেলোনাকে বেশ কয়েকটি কাপ জিততে সাহায্য করে। 
৭ বারের ব্যালন ডি অর জয়ী মেসি  বার্সেলোনার হয়ে যতটা সপ্রতিভ ছিল আর্জেন্টিনার হয়ে প্রাথমিকভাবে নিজেকে সেইভাবে মেলে ধরতে পারছিলেন না। তবুও ২০১৪ সালে একক দক্ষতাতে দলকে ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে তোলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জার্মানির মারিও গোৎসের গোলে তাঁর বিশ্বকাপের স্বপ্নভঙ্গ হয় তবে সেই বছর তিনি জিতে নেন প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের সম্মান। ২০২১ সাল পর্যন্ত মেসি দর্শকের কাছে একজন ক্লাব খেলোয়াড় হিসেবেই চিহ্নিত ছিলেন। তিনি শত চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক খেতাব জয় করতে পারছিলেন না। অবশেষে, ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা কাপ জয়ের সাথে এল এম ১০ সেই আক্ষেপ ঘোচান। এবং এর কিছুদিন পরেই আরও একটি আন্তর্জাতিক কাপ ফাইনালিসিমা বা কনমেবল- উয়েফা কাপ অফ চ্যাম্পিয়ন্স কাপ জয় করেন। তবে ২০২১-২২ মরসুম মেসির জন্য আক্ষরিক অর্থেই ঘটনাবহুল। আন্তর্জাতিক কাপ জিতলেও এই মরসুমেই বার্সেলোনার সাথে বহুদিনের সম্পর্ক ভাঙতে বাধ্য হন। লা লিগার অর্থনৈতিক বেড়াজালে আটকে যায় বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ। মেসির চুক্তি নবায়নে অপারগ হওয়ায় কাতলান ক্লাবের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় মেসি আর বার্সেলোনাতে থাকছে না। এর কিছুদিন পরেই মেসি ফরাসী ক্লাব প্যারিস সাঁ জারমা তে যোগ দেন। তবে এখনো পর্যন্ত লিগ ওয়ানে মেসি সুলভ খেলা দর্শক দেখতে পায়নি। আসন্ন বিশ্বকাপ মেসির হয়তো শেষ বিশ্বকাপ হতে  চলছে। সেখানে মেসির থেকে দর্শক কিছু অভাবনীয় আশা করবে এটা বলাই বাহুল্য।

#Source: online/Digital/Social Media News # Representative Image

Journalist Name : Tamoghna Mukherjee

Related News