২২-এ নাদালের ইতিহাস

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

মনে হচ্ছিল, দৃশ্যটা জ্যাক স্নাইডারের সম্পাদিত কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্য। একদম চরম মুহূর্তে সবকিছু যেন হঠাৎ থমকে গেল। সবকিছু চলছিল আল্ট্রা স্লো মোশনে। দানিল মেদভেদেভের রিটার্ন এগিয়ে এসে মাত্রই ব্যাকহ্যান্ড করেছেন রাফায়েল নাদাল। পড়িমরি করে ছুটছিলেন রাশিয়ান, ওদিকে তাকিয়ে আছেন নাদাল। মেদভেদেভ রিটার্ন করতে পারেন, সেটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কোনো আগ্রহ নেই তাঁর মধ্যে। মেদভেদেভ ঠিকই বলের নাগাল পেলেন। কিন্তু ব্যাটের সে ছোঁয়ায় কিছু যায়–আসে না। তখনই বোঝা গেল, বল নেট পার হচ্ছে না।
সবার আগে সেটা বুঝতে পেরেছেন নাদাল। বল নেটের দিকে যাচ্ছে, ওদিকে নাদালের মুষ্ঠি খুলে যাচ্ছে। বল একটু এগোচ্ছে, নাদালের হাত ও ব্যাটের হাতলের মধ্যে তত দূরত্ব সৃষ্টি করছে। একসময় সম্পর্ক ছিন্ন হলো হাত ও হাতলের। মাধ্যাকর্ষণের জয় হলো। ব্যাট হাতের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে ধীরে ধীরে কোর্টে নামল, বল তখনো ছুটছে। ছুটতে ছুটতে নেটের পাশ দিয়ে বলে যাচ্ছে টেনিস বল, কিন্তু সেদিকে তাকানোর ঠেকা কার!
স্লো মোশন দৃশ্যের মতো করেই সবার দৃষ্টি শুধু একজনে, রাফায়েল নাদালে। ইতিহাসের জন্ম নেওয়া সে মুহূর্ত থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চান কে! যার নামের কোর্টে খেলছেন নাদাল, স্বয়ং রড লেভার নিজে মোবাইল বের করে স্মৃতিতে ধরে রাখছিলেন সে মুহূর্ত।
রড লেভার অ্যারেনায়  দানিল মেদভেদেভকে ২-৬, ৬-৭ (৫/৭), ৬-৪, ৬-৪, ৭-৫ গেমে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে ইতিহাসের জন্ম দিলেন নাদাল। প্রথম কোনো পুরুষ খেলোয়াড় হিসেবে এককে ২১টি গ্র্যান্ড স্লাম জিতলেন ‘এল ম্যাটাডোর!’ রজার ফেদেরার ও নোভাক জোকোভিচের সঙ্গে এত দিন সর্বোচ্চ ২০টি গ্র্যান্ড স্লামের রেকর্ড ভাগাভাগি করছিলেন, রেকর্ডটা আপাতত শুধুই নাদালের।

কেন তাঁকে ‘এল ম্যাটাডোর’ বলে ডাকা হয়, সেটা আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন নাদাল। গত কয়েক বছরে চোটাঘাত তাঁর সর্বোচ্চ পরীক্ষা নিয়েছে। যখনই মনে হয়েছে এবার আর ফেরা হবে না, তখনই ফিনিক্স পাখির বাস্তব রূপ হয়ে ফিরেছেন নাদাল। সবাইকে ভুল প্রমাণ করেছেন কোর্টে। কয়েক মাস আগেই অস্ত্রোপচার করা ৩৫ বছর বয়সী নাদাল  ৫ ঘণ্টা ২৪ মিনিট লড়ে হারিয়ে দিলেন ১০ বছরের ছোট মেদভেদেভকে।
রানারআপের ট্রফি হাতে নিয়ে রাশিয়ান তারকা জানালেন বাকি সবার প্রতিক্রিয়া, ‘৫ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের পর কথা বলা কঠিন। আমি রাফাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। আজ তিনি যা করলেন, আমি চমকে গেছি।’ মেদভেদেভ আরও বলেছেন, ‘আমার স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে চাই, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আমাদের টিভিটা এরই মধ্যে ভেঙে গেছে।’
নাদাল সেদিন যেভাবে ফিরেছেন, তাতে মেদভেদেভের স্ত্রী টিভি ভাঙতেই পারেন। প্রথম সেটে একদমই পাত্তা পাননি নাদাল। ৪২ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া সে সেটে ৬-২ গেমে হেরেছেন স্প্যানিশ মহাতারকা। দ্বিতীয় সেটে দারুণভাবে ফিরেছিলেন নাদাল, এগিয়ে গিয়েছিলেন ৪-১ গেমে। কিন্তু সে সেটকেও টাইব্রেকারে নিয়ে গেলেন মেদভেদেভ, জিতেও গেলেন।

নাদালের ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন তখন বহু দূর। মেদভেদেভ তো তখনই নিজের দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্লাম জেতার স্বপ্ন দেখছিলেন, ‘আমি খেলার চেষ্টা করেছি। খুবই ক্লান্ত ছিলাম। টেনিসটা দারুণ মানসম্পন্ন ছিল। আপনি (নাদাল) দুই সেটের পর মান আরও ওপরে তুলেছেন। আমি তো ভেবেছিলাম ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আপনি একজন দারুণ বিজয়ী। আপনাদের (নাদাল-ফেদেরার-জোকোভিচ) মধ্যে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে এবং এটা আরও বেশ কিছুদিন চলবে।’ 
প্রথম দুই সেট হেরে যাওয়ার পর নাদালকে আর কেউ গোনায় ধরছিলেন না। ধরার উপায়ও ছিল না। গ্র্যান্ড স্লামে প্রথম দুই সেটই হেরে যাওয়ার পর নাদাল ম্যাচ জেতার ঘটনা তো বিরল কিছু। নির্দিষ্ট করে বললে ২০০৭ উইম্বলডনের পর থেকেই গ্র্যান্ড স্লামে কখনো দুই সেট হেরে পরে ম্যাচ জেতেননি এই স্প্যানিয়ার্ড। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে কখনোই পারেননি। শুধু অস্ট্রেলিয়ান ওপেনই কেন, চার ভিন্ন গ্র্যান্ড স্লাম মিলিয়েই মাত্র দুবার দুই সেট পিছিয়ে পড়েও পরে জিতেছেন নাদাল, দুটিই উইম্বলডনে, দুটিই ২০০৭ সালের আগে।
কিন্তু ক্যারিয়ারজুড়েই এমন সব প্রতিকূলতা পার হয়ে এসেছেন নাদাল, যখনই তাঁকে হিসাব থেকে বাদ দিয়েছে, তখনই ফিরে এসেছেন সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে।
ঠিক তা-ই হলো। নাদাল ফিরলেন বিপুল বিক্রমে। তাঁর আগ্রাসন দেখে চমকে গেলেন মেদভেদেভও। প্রথম দুই সেটে দুর্দান্ত রিটার্ন করা এই রুশ তৃতীয় ও চতুর্থ সেটে করলেন অসংখ্য আনফোর্সড এরর। ডাবল ফল্টও ছিল তাঁর। রড লেভার অ্যারেনাও যেন একজন চ্যাম্পিয়নের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনায় জেগে উঠল। নাদালের প্রতিটি পয়েন্টে গর্জন করে উঠছিল গ্যালারি। মেদভেদেভও সে চাপ অনুভব করলেন। দর্শকদের প্রতি হালকা বিরক্তিও প্রকাশ করলেন। ওদিকে নিজের মানসিক দৃঢ়তা ও বিপুল সমর্থনকে সঙ্গী করে পরের দুই সেটই ৬-৪ গেমে জিতে গেলেন নাদাল। ততক্ষণে ৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।

শেষে সেটেও তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন নাদাল। ৫-৩ গেমে এগিয়েও গিয়েছিলেন। মেদভেদেভের সার্ভিস ব্রেক করলেই চ্যাম্পিয়ন। তখনই কেন যেন ছন্দপতন হলো! মেদভেদেভ কোনো সুযোগ না দিয়েই সে গেম জিতে নিলেন। নিজের সার্ভও খোয়ালেন নাদাল। হয়ে গেল ৫-৫। তবে কি শেষে এসে তরি ডুববে? কিন্তু নাদাল সে সুযোগ দেননি। দুবার ডিউস করেও সার্ভ ধরে রাখতে পারেননি মেদভেদেভ। ব্রেক করলেন নাদাল। চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য সার্ভ করতে নামলেন ‘এল ম্যাটাডোর।
নাদালের প্রথম সার্ভ ফেরাতে গিয়ে নেটে পাঠালেন মেদভেদেভ। পরের সার্ভও ঠিকমতো ফেরাতে পারলেন না রুশ তারকা। তিন নম্বর সার্ভ তো ঠেকানোর সুযোগই পেলেন না। ম্যাচে নিজের তৃতীয় এইসের জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর পেতেন না নাদাল। তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্ট নিয়ে সার্ভ করলেন নাদাল, রিটার্ন করলেন মেদভেদেভ, ব্যাকহ্যান্ড নাদালের। আর তারপর? ইতিহাস!  হারের দুঃখ ভুলে মেদভেদেভ নিশ্চয় একদিন না একদিন এমন মুহূর্তে সঙ্গী হতে পেরে গর্ব করতে পারবেন। নাদাল যেমনটা বলেছেন, ‘আমার টেনিস ক্যারিয়ারের অন্যতম আবেগী ম্যাচ ছিল এটি। তোমার সঙ্গে সেই মুহূর্তটা ভাগাভাগি করতে পেরে গর্বিত।’
গর্ব তো মেদভেদেভেরই হওয়ার কথা!

#Source: online/Digital/Social Media News # Representative Image

Journalist Name : Avijit Das

Tags: