ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিচারবিভাগ, নির্বাহী এবং আইনসভার পারস্পরিক ভারসাম্য একটি মৌলিক ভিত্তি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্ট এবং প্রশাসনের মধ্যকার সম্পর্কে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তা এই ভারসাম্যকে নতুন করে চিন্তার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। এরই সর্বশেষ উদাহরণ, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশে ১৪টি গুরুতর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া। এই পদক্ষেপ শুধু নজিরবিহীন নয়, বরং তা এক সাংবিধানিক সংঘাতের সম্ভাবনাকেও সামনে আনছে।
প্রসঙ্গত, ঘটনার সূত্রপাত হয় সুপ্রিম কোর্টের এক যুগান্তকারী রায় থেকে। সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের এক ডিভিশন বেঞ্চ মন্তব্য করে যে, রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতি আইনসভায় গৃহীত কোনো বিল অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখতে পারেন না। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তাঁদের সেই বিল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। এই রায়কে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। অনেকের মতে, এই রায়ের মাধ্যমে আদালত কার্যত রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের উপর ‘নির্দেশমূলক’ কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেছে, যা ভারতের ফেডারেল কাঠামোর পরিপন্থী হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করে সুপ্রিম কোর্টের কাছে যে ১৪টি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, তা বিচারবিভাগের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার মঞ্চ তৈরি করেছে। উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:
সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের উপর সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারে?
আদালতের বিশেষ ক্ষমতা কি রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে?
বিচারবিভাগ কি নির্বাহীর সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারে?
সুপ্রিম কোর্টের রায় কি রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের সাংবিধানিক ক্ষমতা খর্ব করছে না?
ভারতের ৫২তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ নিলেন বিচারপতি বিআর গভাই, ইতিহাসে প্রথম বৌদ্ধ মুখ
উলেখ্য, এই পরিস্থিতি অনেকেই ‘সাংবিধানিক সংকট’ বলে মনে করছেন, বিশেষত এমন এক সময় যখন কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্ক ইতিমধ্যেই তীব্র রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের বিরোধ গণতন্ত্রের মূল কাঠামোতে আঘাত হানতে পারে যদি এর সমাধান আইন ও সংবিধান অনুযায়ী না করা হয়। এই মুহূর্তে ভারতের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন বিচারপতি বি আর গাভাই। রাষ্ট্রপতির ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিতে এখন তাঁকে একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ গঠন করতে হবে, যার সদস্য সংখ্যা হবে কমপক্ষে পাঁচজন। এই বেঞ্চের মতামতই হবে রাষ্ট্রপতির প্রশ্নের আনুষ্ঠানিক উত্তর। এটি বিচারপতি গাভাইয়ের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ, কারণ এখানে আদালতের কর্তৃত্ব এবং নির্বাহীর সাংবিধানিক মর্যাদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটাই মুখ্য। রাষ্ট্রপতির ১৪৩ ধারা প্রয়োগ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদক্ষেপ। তবে এই প্রশ্নোত্তর পর্বে শুধু আইনের ব্যাখ্যা নয়, উঠে আসবে ভারতের গণতন্ত্রের প্রকৃত চেহারাটিও। আদালতের দায়িত্ব এখন শুধুই আইনি ভাষায় জবাব দেওয়া নয়, বরং সংবিধান ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এক সুবিবেচিত ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও।