ওয়াকফ বিল কী ? চলুন বিস্তারিত জেনে আসি
সম্প্রতি ভারতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে ওয়াকফ সংশোধনী বিল, যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিজেপি সরকার দাবি করছে যে, এই বিলটির মাধ্যমে সাধারণ মুসলিমরা উপকৃত হবেন, তবে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে তৃণমূল ও কংগ্রেসের মধ্যে এর বিরুদ্ধে বিরোধিতার ঝড় উঠেছে। এই প্রতিবেদনটি সেই বিতর্কের খুঁটিনাটি তুলে ধরবে।
ওয়াকফ কী?
ওয়াকফ হল একটি ইসলামিক ধারণা, যেখানে ধর্মাবলম্বীরা তাদের সম্পত্তি সমাজের উন্নতি ও ধর্মপ্রচার জন্য দান করেন। ওয়াকফ সম্পত্তি কখনও বিক্রি করা যায় না বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায় না, কারণ মুসলমানরা এটিকে ঈশ্বরের সম্পত্তি হিসেবে মনে করেন।
ওয়াকফ বোর্ড কী?
ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বোর্ড বা কমিটি গঠন করা হয়। এই ধারণা সুলতানি আমলে শুরু হয় এবং তা পরে স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন আকারে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়াকফ বোর্ডের কাজ হচ্ছে ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা। বর্তমানে এই বোর্ডের অধীনে ৮.৭ লক্ষেরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে, যা ৯.৪ লক্ষ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।
ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিশ্লেষণ
বর্তমানে ৪০ নম্বর ধারার অধীনে, ওয়াকফ বোর্ডকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে যে, তারা কোন সম্পত্তি বা জমি দখল করতে পারে এবং সরকারের কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই তা করতে পারে। সরকার কোন আইনি দখল বা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই বিলের মাধ্যমে, সরকার ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার কমানোর চেষ্টা করছে এবং একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণের প্রস্তাব দিয়েছে।
নতুন সংশোধনী:
নতুন সংশোধনীতে, সরকার ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করছে। নতুন আইনে, ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা জেলা প্রশাসক বা সমপদমর্যাদার কর্মকর্তার হাতে দেওয়া হবে। এমনকি, কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, এখন তা চ্যালেঞ্জ করা যাবে, যা আগে সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে, ইসলামিক ধর্মস্থান বা প্রার্থনাস্থলও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দাবি করা যেতে পারে। এছাড়া, নতুন বিলে ওয়াকফ বোর্ডে দুই অমুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বিধানও রাখা হয়েছে, যা বিরোধীদের জন্য একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছে।
সরকারের যুক্তি:
সরকারের মতে, বর্তমান আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বা জমি সরকারের পর্যালোচনার বাইরে থাকে। তারা দাবি করছে যে, ওয়াকফ সম্পত্তির সুফল শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ভোগ করছে, এবং সাধারণ মুসলিমরা উপকৃত হচ্ছেন না। সরকারের মতে, এই বিল পাশ হলে সাধারণ মুসলিমরা উপকৃত হবেন, এবং সাচার কমিটির রিপোর্টেও ওয়াকফ আইন সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
বিরোধীদের যুক্তি:
তবে বিরোধী দলগুলো, বিশেষ করে ইন্ডিয়া জোট, এই বিলকে "ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বত্ত্বায় আঘাত" হিসেবে দেখছে। তাদের দাবি, এই বিলটি মূলত মুসলমানদের ধর্মীয় সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে। বিশেষত, ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিরোধীদের আপত্তি রয়েছে, কারণ তারা মনে করেন, এতে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে পক্ষপাতিত্ব প্রকাশিত হবে।
চিরঘুমের দেশে হলিঊডের ব্যাট্ম্যান ভ্যাল কিলমার
বিরোধিতার মূল কারণ
১. ধর্মীয় সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ: বিরোধীদের প্রধান উদ্বেগ হল যে, এই বিলটি মুসলিম ধর্মীয় সম্পত্তির উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করবে, যা তাদের মতে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ভারতীয় সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী।
২. অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি: ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবও বিরোধী দলগুলোর জন্য একটি বড় বিতর্কের বিষয়, কারণ এতে তারা মনে করছেন যে, মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়গুলিতে অন্য ধর্মের মানুষদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে, যা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না।
৩.ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সরকারের উদ্দেশ্য: বিরোধীদের দাবি, এই বিলটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মের সম্পত্তির উপর সরকারের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরুদ্ধে যাবে।
ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। সরকার একদিকে দাবি করছে যে এটি মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য, তবে বিরোধী পক্ষটি মনে করছে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য হুমকি। এখন দেখার বিষয় হবে, এই বিতর্কের মধ্যে বিলটি কীভাবে পার্লামেন্টে পাস হয় এবং এর ফলে দেশের ধর্মীয় ও আইনগত কাঠামোতে কী ধরনের পরিবর্তন আসে।