শনিবার দক্ষিণ ইজরায়েলের বিভিন্ন শহরে হামাস যে সন্ত্রাস চালিয়েছে, তাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। এটা স্বাধীনতার লড়াই নয়। আবার, গত কয়েক দশক ধরে ইজরায়েলিরা যেভাবে প্যালেস্টাইনিদের জমি-বাড়ি দখল করেছে, তাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, তাকেও সমর্থন করার কোনও জায়গা নেই। তাহলে, মধ্যপ্রাচ্যের এই পরিস্থিতির দায় কার?
হামাসের অতর্কিত হামলায় প্রাথমিকভাবে ব্যাকফুটে যাওয়ার পর, পাল্টা লড়াই শুরু করেছে ইজরায়েল। ৫০ বছর পর প্রথমবার তারা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মনে করা হচ্ছে, এবার পূর্ণ শক্তি নিয়ে গাজা ভূখণ্ড থেকে হামাসকে নির্মূল করার জন্য ঝাঁপাবে ইজরায়েল। গত চারদিন ধরে গাজায় ইজরায়েলি বিমান হামলা চলছে। ইতিমধ্যেই গাজাকে ভারী মূল্য চোকাতে হয়েছে। তবে, মনে করা হচ্ছে এটা সবে শুরু। আসন্ন দিনগুলিতে আরও খারাপ সময় দেখতে হবে গাজাকে। ইজরায়েল অবশ্যই চাইবে এই যুদ্ধকে গাজা এবং হামাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে। কিন্তু, সব তো তাদের চাহিদা মতো হবে না। ইতিমধ্যেই হামাসের পক্ষ থেকে ওয়েস্টব্যাঙ্কের প্যালেস্টাইনিদের এবং আরব দেশগুলিতে ইজরাইলের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ইতিমধ্যেই, লেবানন এবং সিরিয়ার দিক থেকে ইজরায়েল লক্ষ্য করে রকেট ছোড়া শুরু করেছে হিজবুল্লাহও। কাজেই একাধিক ক্ষেত্রে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে ইজরায়েল। এমনকী, এই যুদ্ধ গোটা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ারও গুরুতর সম্ভবনা তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই শতাব্দী প্রাচীন দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে শুরু হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরও, অনেকেই বারংবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা করেছেন। বিশেষ করে রাশিয়ার মতো পরমাণু শক্তিধর দেশ জড়িত থাকায় বাড়তি উদ্বেগ ছিল। আমেরিকা বা ন্যাটো সেই যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করলে, রাশিয়া যোগ্য জবাব দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল। তবে, সেই যুদ্ধ ছিল একেবারেই আঞ্চলিক সমস্যা। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্ব কিন্তু তা নয়। একেবারে শুরু থেকেই এই সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। অনেক বেশি বিস্তৃত সংঘাতে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এই যুদ্ধের। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ।
ইজরায়েল তীব্র পাল্টা আক্রমণ শুরু করার পরও, হামাস ইজরায়েলে হামলা থামায়নি। বরং, ইচ্ছাকৃতভাবে ইজরায়েলকে হামলার জন্য উসকানি দিয়ে চলেছে। অনেকেই মনে করছে, আসলে ইজরাইলের জন্য একটা ফাঁদ তৈরি করেছে হামাস। সম্ভবত আরও বৃহত্তর এক যুদ্ধ শুরুর লক্ষ্যেই তারা ইজরায়েলি প্রতিক্রিয়াকে উসকে দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইজরায়েল সরকার সাফ জানিয়েছে, হামাসকে তারা নিশ্চিহ্ন করবে। কিন্তু কিভাবে? গাজা ছোট্ট এলাকা হলেও, অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। কাজেই এখানে একতরফা বোমা হামলা চালিয়ে যওয়া সম্ভব নয়। যত বেশি হামলা হবে, ততই সাধারণ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। আর ততই প্যালেস্টাইনপন্থী দেশগুলির যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, ইরাক ও আফগানিস্তানে অতীতে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বর্তমানে ইউক্রেনে অভিযান করতে গিয়ে রাশিয়া যেভাবে ফেঁসে গিয়েছে, সেভাবে গাজায় আটকে যেতে পারে ইজরায়েল। কারণ, হামাস ও হিজবুল্লাহ, আল-কায়েদা বা আইএসআইএস-এর মতো কোনও সন্ত্রাসবাদী দল নয়। তারা আধাসামরিক বাহিনী। এমনকি, কোনও কোনও রাষ্ট্রের থেকেও তারা বেশি শক্তিশালী। এই দলগুলোকে সহজে দমন করা যাবে না। হামাসের হামলার প্রস্তুতি, তার গোপনীয়তা – এই গোষ্ঠীর ক্ষমতার প্রমাণ।
গাজার পরই ইজরায়েলের দ্বিতীয় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক। প্যালেস্টাইনের এই অংশ ফাতাহর দখলে থাকলেও, হামাসের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ইতিমধ্যেই এই দিক থেকে হামাসের সমর্থনে হামলা চালাতে শুরু করেছে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী। ইরান এবং সিরিয়া দুই দেশের সরকারই হামাস এবং হিজবুল্লাহ – দুই যোদ্ধা গোষ্ঠীরই প্রধান সমর্থক হিসাবে পরিচিত। ইতিমধ্যেই ইজরায়েলে হামলার পিছনে ইরানের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ইরানের বিরুদ্ধে ইজরায়েল যদি প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনও পদক্ষেপ করে, তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সরাসরি ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে পারে ইরান ও সিরিয়া।
এই দুই দেশ যোগ দিলে ইজরায়েলের উপর হামলা করার জন্য চাপ পড়বে অন্যান্য আরব দেশগুলির উপরও। গাজায় ইজরায়েল যেভাবে দাঁত-নখ বার করে প্রতিশোধের খেলায় মেতেছে, তাতে এমনিতেই আরব দেশগুলির উপর ইজরালেরে বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার চাপ বাড়ছে। সৌদি আরব-ইজরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, হামাস-হিজদবুল্লাহ ইতিমধ্য়েই হুমকি দিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বন্দ্বে নাক গলালে, তাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এর মধ্যে বুধবারই আমেরিকা থেকে অস্ত্র এসে পৌঁছেছে ইজরায়েলে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশও ইজরায়েলের পক্ষই নিয়েছে। তবে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ এবং তাদের মিত্র শক্তিগুলিই নয়, মধ্য়প্রাচ্যের এই দ্বন্দ্বে অংশ নিতে পারে রাশিয়া-তুরস্কের মতো আরও বেশ কয়েকটি দেশও।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে, এমনিতেই রাশিয়াকে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় শক্তিগুলির বিবিধ নিষেধাজ্ঞার প্রতিরোধ করতে হয়েছে। ইউক্রেন থেকে পশ্চিমী শক্তির নজর ঘোরাতে, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের মতো এই সমস্যার প্রয়োজন ছিল মস্কোর। তাছাড়া, আইএস জঙ্গিদের মোকাবিলা করার দিন থেকেই, সিরিয়া, ইরান, তুরস্কের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার অভিজ্ঞতা রয়েছে রাশিয়ার। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের এক গোষ্ঠী হিসেবেই ধরা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যায় আমেরিকা হস্তক্ষেপ করলে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়েছেন পুতিন।
এদিকে আবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এর্দোগান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নব্য-খলিফা হিসেবে তুলে ধরতে চান। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বে, প্যালেস্টাইনিদের সমর্থন, তাঁর সেই পরিচয় প্রমাণের বড় অস্ত্র হতে পারে।
পাকিস্তানও বসে থাকবে কেন। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন পরিস্থিতিকে তারা কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। প্যালেস্টাইনিদের সমর্থনের মাধ্যমে, তারা ভবিষ্যতে কাশ্মীর নিয়ে সংঘাতের ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের সমর্থনের আদায় করার চেষ্টা করতে পারে।
ভারতের জন্য, পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। নরেন্দ্র মোদী ইজরাইয়েল পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। কংগ্রেস সহ কিছু বিরোধী দল আবার প্যালেস্টাইণের সমর্থনের কথা বলছে। কিন্তু, ইজরায়েলের পক্ষে নয়াদিল্লির এই খোলাখুলি সমর্থনে, নষ্ট হতে পারে ইরান এবং আরব দেশগুলির সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক। গত কয়েক বছরে যে সম্পর্ককে তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মায় অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। মাথায় রাখতে হবে, শক্তি, বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে। অন্যদিকে, ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গেলে, তেল আবিবের সঙ্গে নয়া দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্টের আশঙ্কা থাকবে। সামরিক ক্ষেত্র-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইজরায়েলের উপর নির্ভর করে ভারত।
প্যালেস্টাইনকে বলা হয় ধর্মের আঁতুড়ঘর। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম – তিন ধর্মের মানুষই এই জায়গাকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন। ষোড়শ শতাব্দী থেকে প্যালেস্টাইনের দখল ছিল অটোমান শাসকদের হাতে। অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এই পবিত্র ভূমি। তিন ধর্মের মানুষেরই মোটামুটি শান্তিপূর্ণ অবস্থান ছিল। কিন্তু, ইউরোপে দীর্ঘ সময় ধরেই বিভিন্ন কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন জোর জুলুম চলত। আঠারো শতক থেকে ধীরে ধীরে ইহুদিদের এক আন্দোলন গড়ে ওঠে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের একজোট করা এবং ইহুদিদের জন্য একটি পৃথক দেশ স্থাপন। যা পরবর্তীকালে ‘জ়ায়নবাদ’ হিসেবে পরিচিত হয়।
১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথম জ়ায়নবাদী কংগ্রেসের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ঠিক হয়, ইহুদিদের পবিত্রভূমি গড়ে তোলা হবে প্যালেস্টাইনে। প্যালেস্টাইনই তাদে পূর্বভূমী বলে দাবি করে তারা। একদিন প্যালেস্টাইনে তাদের দেশ গঠিত হবে এই আশায়, সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ইহুদিরা অটোমান-প্যালেস্টাইনে পাড়ি দিতে শুরু করেছিল।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা। অটোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করতে, বিভিন্ন আরব গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করেছিল ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের জন্য তাদের উসকেছিল। ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যুদ্ধে অটোমানদের হার হলে, তারা আরবদের স্বাধীনতা দেবে। একটি আরব দেশকে স্বীকৃতি দেবে। যুদ্ধে অটোমানদের পরাজয় হয়, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স জিতে যায়।
১৯১৬ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ‘সাইক্স-পিকো’ চুক্তি নামে এক গোপন চুক্তি করেছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। চুক্তির মূল কথা ছিল, যুদ্ধের পর আরব দেশকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে ব্রিটিশ এবং ফরাসীরা। যুদ্ধে, মার্কিনীদের সহায়তার প্রয়োজন ছিল ব্রিটিশদের। যুদ্ধে যাতে মার্কিন সরকার ব্রিটেনকে সহায়তা করে, তার জন্য চাপ তৈরি করতে মার্কিন ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ব্রিটিশরা। বেলফোর ডেক্লারেশনের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটিশরা। অর্থাৎ, একই জায়গায় প্রথমে আরব এবং পরে ইহুদিদের দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটেন।
দ্ধের পর অবশ্য কারোরই শিকে ছেঁড়েনি। প্যালেস্টাইনকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেড হিসেবে ঘোষণা করেছিল ব্রিটেন। কিন্তু, ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতিতে আশাবাদী ইহুদিরা আরও বেশি সংখ্যায় প্যালেস্টাইনে আসা শুরু করে। প্যালেস্টাইনে ইহুদি জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় অসন্তুষ্ট হয়েছিল আরবরা। কিন্তু, এর মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জার্মানিতে শুরু হয় নির্বিচারে ইহুদি গণহত্যা, জাতিগত শুদ্ধিকরণ। এর ফলে, প্রাণ বাঁচাতে আরও বেশি সংখ্যক ইহুদি প্যালেস্টাইনে পাড়ি দিতে থাকে। ১৯১৮ সালে প্যালেস্টাইনে ইহুদি জনসংখ্যা যেখানে মাত্র ৬ শতাংশ ছিল, ১৯৪৭-এর মধ্যে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশে পরিণত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু, ততদিনে তাদের উপনিবেশ পরিচালনার মতো ধন-সম্পদ ফুরিয়েছে। ফলে, প্যালেস্টাইন নিয়ে কী করবে, তা ভেবে পায়নি ব্রিটেন। প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ তারা সঁপে দেয় সদ্য গঠিত হওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের হাতে। রাষ্ট্রপুঞ্জ পড়েছিল মহা ফাঁপড়ে। একদিকে, সদ্য গণহত্যার সাক্ষী হওয়া ইহুদি সম্প্রদায় দাবি করছে, তাদের মাথা গোঁজবার মতো একটি দেশ চাই, যেখানে তারা শান্তিতে থাকতে পারবে। অন্যদিকে, আরব সম্প্রদায়ের দাবি ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল ইংল্যান্ড। তাদের জায়গা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে ইহুদিদের এনে প্যালেস্টাইনে বসানো হয়েছে। ইহুদি গণহত্যা তো প্যালেস্টাইনিরা করেনি, হিটলারের পাপের দায় তাঁরা কেন নেবে?
অনেক আলাপ আলোচনার পর রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘দুই দেশ সমাধান’ বের করেছিল। প্যালেস্টাইনকে ভাগ করে ইহুদিদের জন্য ইজরায়েল এবং আরবদের জন্য প্যালেস্টাইন গঠন করা হবে। জেরুসালেমের উপর দাবি ছিল দুই পক্ষেরই। তাই এই পবিত্র শহরের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। প্যালেস্টাইনের ৫৫ শতাংশ জমি গিয়েছিল ইহুদিদের ভাগে। ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের আপত্তি সত্ত্বেও, ১৯৪৭-এর ২৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জে এই দুই দেশ সমাধানের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। এর একদিন বাদই, ৩০ নভেম্বর প্যালেস্টাইনে যুদ্ধ শুরু হয় আরব যোদ্ধা এবং ইহুদি যোদ্ধাদের মধ্যে। সেই যুদ্ধে জয় পেয়েছিল ইহুদিরাই।
১৯৪৮-এর ১৪ মে ইজরায়েল নিজেদের স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ওই দিনই ৬ আরব দেশ একযোগে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বিস্ময়করভাবে, সবকটি আরব দেশকে পরাস্ত করেছিল ইজরায়েল। ৫৫ শতাংশ থেকে প্যালেস্টাইনের ৭৮ শতাংশ জায়গার দখল আসে ইজরায়েলের হাতে। ৭ লক্ষ প্যালেস্টাইনি নাগরিক ভিটেছাড়া হন। আর এই যুদ্ধই ছিল আজকের ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের ভিত্তি।
১৯৫৬ সালে সুয়েজ ক্যানেলকে তাদের জাতীয় সম্পদ বলে ঘোষণা করেছিল মিশর। ইজরায়েলের জন্য ওই ক্যানাল ব্যাবহার নিষিদ্ধ করেছিল। মিশর আক্রমণ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইজরায়েল। মিশরের বহু জায়গা দখল করলেও, পরে আন্তর্জাতিক চাপে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল তারা। তবে, এই যুদ্ধ পরিষ্কার করে দিয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলই পশ্চিমী দেশগুলির মিত্র শক্তি।
১৯৬৭ এবং ১৯৭৩-এ তৃতীয় ও চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধেও ইজরায়েলকে পরাস্ত করতে পারেনি আরব দেশগুলির জোট। পরিবর্তে, গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, সিনাই, গোলান হাইটসের মতো প্যালেস্টাইনের আরও অনেক এলাকা দখল করে ইজরায়েল।
১৯৭৮ থেকে ইজরায়েল এবং মিশরের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। আসলে একের পর এক যুদ্ধে হারের পর, আরব দেশগুলিও বুঝে গিয়েছিল রণাঙ্গনে ইজরায়েলি বাহিনীকে হারানো সোজা নয়। তার থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ১৯৮২-তে ইজরায়েল গাজা-সহ বেশ কিছু প্যালেস্টিনিয় এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে। কিন্তু, তারপরও বহু এলাকা তাদের দখলেই থেকে যায়।
আজও, প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো আচরণ করে ইজরায়েল সরকার, এমনটাই অভিযোগ বহু মানবাধিকার সংগঠনের। ছলে-বলে প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের জায়গা-জমি ছিনিয়ে নেওয়া, কথায় কথায় তাদের কারাগারে বন্দি করা, আল আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার অনুমতি না দেওয়া, যখন-তখন তাদের হত্যা করা, তাদের খাবার-জল-বিদ্যুতের মতো প্রাথমিক চাহিদাগুলি থেকে বঞ্চিত করার মতো হাজারো অভিযোগ রয়েছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে, প্যালেস্টাইনের দখলে থাকা এলাকাগুলিতেও, বহু সংখ্যায় ইজরায়েলি নাগরিকরা বসতি স্থাপন করেছেন। ফলে, দুই দেশ সমাধানও আর প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কারণ আগের প্যালেস্টাইনি জায়গাগুলির অনেকটাই এখন ইজরায়েলিদের দখলে।
এদিকে, শুধু বাইরে থেকে যুদ্ধ নয়, প্যালেস্টাইনকে দখলমুক্ত করতে প্যালেস্টাইনিদের মধ্যেও বহু সংগঠন তৈরি হয়েছিল। এদেরই ছাতা সংগঠন হিসেবে ১৯৬৪ সালে আত্মপ্রকাশ করে ইয়াসির আরাফতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনকেই প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে, প্যালেস্টাইনিদের মধ্যেই একাংশের দাবি ছিল, পিএলও বড় নরমপন্থী। তাই, ১৯৮৭ সাল জন্ম নেয় যোদ্ধা সংগঠন হামাস। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট, গোটা প্যালেস্টাইনকে ইজরায়েলের দখলমুক্ত করা হবে এবং সেখানে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই হামাসই আজ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা করেছে। ইজরায়েল ঘোষণা করেছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। তবে, এই যুদ্ধ তো গত কয়েক দশক ধরে চলছেই। কাজেই সহজে শেষও হওয়ার নয়।