নদী আপনবেগে পাগলপারা'। পৃথিবীর যে কোনও নদীর ক্ষেত্রেই এই বাক্য প্রযোজ্য। নদী তার আপন খেয়ালে বয়ে চলে মোহনার দিকে। তার জলরাশি কখনও শান্ত, কখনও বা উত্তাল। প্রকৃতি চিরকালই আমাদের তার রূপে আশ্চর্য করেছে। দীর্ঘদেহী পাহাড় থেকে সবুজের প্রসারতা কিংবা নীল জলরাশির গভীরতা প্রকৃতি তার রূপ ঢেলে দেয় পৃথিবীর বুকে। সেরকমই এক আশ্চর্য রূপ ধরা পড়ে কলম্বিয়ার সেরানিয়া দে লা ম্যাকারেনা এলাকার রঙিন নদীতে।
বিজ্ঞান বলে, জলের নিজস্ব কোনও রং নেই। দূষণজনিত বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক কারণে কখনও ধূসর, কখনও নীল কখনও আবার নদীর জলে দেখা যায় সবুজ ছায়া। কিন্তু এই নদীর রঙের পেছনে রয়েছে সম্পূর্ন প্রাকৃতিক কারণ। শুধু নীল, সবুজ নয় সাথে লাল , হলুদ , গোলাপী রঙের জল বয়ে চলেছে পাশাপাশি।
ক্যানিয়ো ক্রিস্টেলস্ নামের এই নদী রয়েছে কলম্বিয়ার সেরানিয়া দে লা ম্যাকারেনা এলাকায়। পোশাকি নাম একটা থাকলেও রংবেরঙের জলের জন্য এই নদীকে কেউ বলেন 'রিভার অফ কালার্স' বা রঙিন নদী, কেউ আবার 'লিকুইড রেনবো' বা তরল রামধনু বলে চেনেন নদীটিকে। অনেকের কাছে এই নদী 'মেল্টেড রেনবো' বা গলিত রামধনু। কলম্বিয়ার এই রঙিন নদীতে সাত রঙের জল একসঙ্গে বইতে দেখা যায়। রক্তাভ লাল, উজ্জ্বল নীল, গাঢ় সবুজ, হলুদ, বেগুনি রঙের জলের পাশাপাশি দেখা যায় গোলাপি, কমলা, মেরুন রঙের প্রবাহও। বছরের পর বছর ধরে এ ভাবেই বয়ে চলেছে 'লিকুইড রেনবো'। স্থানীয়েরা তো বটেই, বহু মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এই নদী দেখতে ভিড় করেন কলম্বিয়ায়। ক্যানিয়ো ক্রিস্টেলসের রংবেরঙের জল দেখার সবচেয়ে ভাল সময় জুলাই থেকে নভেম্বর।
কিন্তু প্রশ্ন হল কেনো এই নদী রঙিন?
আসলে নদীর জল রঙিন নয়। তা কাচবত্ স্বচ্ছ। নদীর গর্ভে থাকা এক প্রকার জলজ উদ্ভিদের কারণে এই জলকে রঙিন দেখায়। ওই উদ্ভিদের নানা রঙের প্রতিফলন দেখা যায় নদীর স্রোতে। সূর্যের আলোয় তা আরও ঝলমল করে ওঠে। জলে ডুবে থাকা সেই উদ্ভিদের নাম ম্যাকারেনিয়া ক্ল্যাভিগেরা। নদীখাতের নীচে হাজার হাজার বছরের পুরনো কোয়ার্টজ়াইট শিলাকে আঁকড়ে এই গাছের সংসার। কলম্বিয়ার সেরানিয়া দে লা ম্যাকারেনা অঞ্চলের নামকরণও হয়েছে এই উদ্ভিদের নামেই। এলাকার একাধিক নদীতে উদ্ভিদটি পাওয়া যায়। তবে স্থান, কাল এবং আবহাওয়ার গতিবিধি ক্যানিয়ো ক্রিস্টেলসকেই রামধনুরঙা জলের আদর্শ ঠিকানা করে তুলেছে, দাবি বিশেষজ্ঞদের। নদীতে খুব বেশি জল থাকলে বা জলের পরিমাণ খুব কমে গেলে রংবেরঙের খেলা আর দেখা যায় না। কম জলে গাছ শুকিয়ে খয়েরি হয়ে যায়। আবার বেশি জল থাকলে নদীর নীচ পর্যন্ত দেখা যায় না। ফলে নদীতে রামধনুও হয়ে যায় গায়েব।
প্রকৃতির বুকে আশ্চর্য এই রঙের খেলা দেখতে হলে মধ্য কলম্বিয়ার ভিলাভেন্সিয়ো শহরে পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে আরও একটি বিমানে যেতে হবে লা ম্যাকারেনায়। 'লিকুইড রেনবো' ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য সেখান থেকে মিলবে 'গাইড'। সেরানিয়া দে লা ম্যাকারেনা অত্যন্ত নিরিবিলি একটি পাহাড়ি জনপদ। খুব বেশি মানুষ সেখানে থাকেন না। স্থানীয় কয়েকটি পর্যটন সংস্থা নদীটি পর্যটকদের ঘুরিয়ে দেখান। কোথাও কোথাও রঙিন জলে সাঁতার কাটার সুযোগও মেলে।