বাংলার হেঁসেল থেকে আস্তে আস্তে বাঙালির প্রিয় খাদ্য গুলি কেমন যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সব রান্নার স্বাদ যারা পেয়েছেন, তারাই বোঝেন খাঁটি বাঙালির রান্না, রান্নার স্বাদ, আসলে কি হয়। বাঙালিদের খাদ্যের তালিকা কিন্তু নেহাতই ছোট নয়। এখনকার প্রজন্মের কাছে এই সব খাবার তুলে দিলে তারা কি এই সব খাবার খাবে? বোধয় না, অথবা বোধয় হ্যাঁ। এখনকার প্রজন্মের মানুষেরা সব তো আবার ওই ডায়েটিংয়ে বিশ্বাসী। বাড়ির ঠাম্মা – দিদা, পিসিমা, এদের হাতের রান্নার স্বাদ যারা পেয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, সেই খাবার সামনে থাকলে, ডায়েটিং কেন ডাক্তারের বারণ থাকলেও নিজেকে আটকিয়ে রাখা কতোটা কঠিন। মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট, তেল কই, এঁচোরের পাথুড়ি, মাটন কষা, পোনা মাছের কালিয়া, দেশী মুরগির রসা, এই সব তো প্রায় এখন উঠেই গেছে। আস্তে আস্তে কি বাঙালি তাদের পছন্দের খাবারগুলি ভুলে যাচ্ছে?
আমাদের সাথে এই মুহূর্তে এখনকার প্রজন্ম থেকে রাজ সেন আছেন, আমরা তার সঙ্গে কথা বলে তার বক্তব্য শুনে নি।
“আচ্ছা রাজ আপনার কি মনে হয়,একসময় বাঙালিরা যেই সব খাবার তাদের পছন্দের তালিকায় রাখতো, সেই সব খাবার আজকাল মানুষ প্রায় ভুলেই যেতে চলেছে, এটা কি ঠিক?
“অবশ্যই। এখনকার মানুষ অনেক স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছেন। আগেকার দিনের মা,ঠাম্মা,দিদারা যেমন রান্না করতেন, ওই তেল ঝোল কষা কষা রান্না, ওই সব আমাদের জেনেরাশনের(প্রজন্মে) মানুষজন খেতে গেলে কয়েকবার ভাবে। তাহলে একসেপ্ট করার থেকে বেশি সেটাকে এভয়েড(avoid) করতে চায়।
“ রাজ তাহলে কি বাঙালির সব পছন্দের রান্না আর কোনোদিনও তাদের খাবারের তালিকায় বা তাদের পাতে ফিরবে বলে আপনার মনে হয়?”
“এখন মানুষ কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে তাদের পছন্দের খাবার পেলেও সহজে মন খুলে খেতে পারেন না, মনের মধ্যে চলে অনেক ভাবনা, যদি ফ্যাট বেশি হয়ে যায়, আজ যত খাওয়া হবে কাল সেই তুলনায় অনেকটা বেশি এক্সারসাইজ করতে হবে, যদি এই তেলঝাল খাবার শরীরে ক্ষতি করে, এই সব ভেবে মানুষ এগোতে ভয় পায়। আর এরকম চলতে চলতে মানুষ এখন খাঁটি, আসল বাঙালি খাওয়ারের স্বাদটাই ভুলে গেছে। এখন খাঁটি বাঙালির খাবারের জায়গা নিয়েছে বিদেশি খাবার, ভিনদেশীয় খাবার। তাও অনেকের বাড়িতে শুনি মাঝে মাঝে বাঙালিয়ানা খানার আয়োজন হয়, তবে ওই যে বললাম ডায়েট মেইনটেইন করতে হবে তাই কম তেল, কম মশলা দিয়ে বানানো হয়ে থাকে।“
“অনেক, অনেক, ধন্যবাদ রাজ আপনাকে। তো দেখাই গেল যে এই প্রজন্মের মানুষের কি বক্তব্য বাঙালির পছন্দের খাওয়ার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।”
“এখন আমাদের সাথে পুষ্প ঠাম্মা আছেন, আচ্ছা ঠাম্মা আপনার কি মনে হয় বাঙালিদের হেঁসেলে,বাঙালি খাবাররের সেই পুরোনো স্বাদ কি আছে?”
“স্বাদ আর এখন কোথায় সব? এখনকার ছেলেমেয়ে গুলো তো সব কি যে সব খায় কে জানে। এরা তো ঘরের খাবার যত না খাবে তার থেকে বেশি বাইরে ওই, কি সব হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে গাদা গাদা টাকা দিয়ে কিনে এনে খাবে। বাড়িতে বানিয়ে নিতে বললে বললে, “ধুরর অতো সময় কই? তার থেকে বরং কিনে আনাই ভালো, সময় বাঁচবে, আর পরিশ্রমটাও কম হবে। আমাদের কালে মা-কাকিমারা কি সুন্দর সব রান্নাবান্না করতো, আর কেমন সব বাহারি নামো ছিল, এই যেমন :- কাঁচকলার খোসার ঘন্ট, রুইমাছের শুক্তো, ডুমুরের ডালনা, নারকোল চিংড়ির বড়া, উচ্ছের কোফতা কারী, শাপলার ভেলাভাজা,কচু বাটা, আর শেষপাতে সবজির অম্বল। এখনকার দিনের বাচ্চারা এই সব শুনলে হয় নাক শিটকাবে আর নাহলে বলবে, “এই সব নাম তো কোনোদিনও শুনিনি,থাক বাবা নিশ্চয়ই অনেক খাটনি পড়ে যায় এই গুলো রান্না করতে , এতো খাটনি আমি করতে পারবো না বাবা”.
“ঠাম্মা সেই পুরোনো দিনের কয়েকটা রান্নার নাম তো আপনি বললেন, সাথে যদি ১-২ রেসিপিও আমাদেরকে জানাতেন যেই গুলো খুব সহজেই বাড়িতে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই বানিয়ে ফেলা যায় এবং খেতেও খুব সুস্বাদু হয় যাতে আজকালকার ছেলেমেয়েরা কোনো ভাবনা চিন্তা ছাড়াই বাড়িতে বানিয়ে নিতে পারে।”
“আমি ২-৩টে রান্নার রেসিপি বলে দিচ্ছি, বাড়িতে একবার বানিয়ে খেলে আবার বারবার খেতে মন চাইবে।
কচু বাটা :-
উপকরণ :-
মানকচু, পিঁয়াজ কুচি, ৪-৫টা কাঁচাপাকা লঙ্কা, ৫০গ্রাম গোটা কালো সর্ষে, আন্দাজমত নুন, আর কাঁচা সর্ষের তেল।
প্রণালী :-
প্রথমে মানকচু খুব ভালো করে পরিষ্কার করে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। তারপর মাঝারি সাইজের টুকরো করে ঈষদুষ্ণ গরমজলে ডুবিয়ে রাখুন কিছুক্ষন। তারপর সেই গুলো সেদ্ধ করে নিন। কচু সেদ্ধ হয়ে গেলে, ঠান্ডা হতে দিন, তারপর কচুগুলোকে চিপে সব বাড়তি জল বের করে দিন। শীলনরা বা মিক্সার গ্রাইন্ডারে প্রথমে কালো সর্ষে, পিয়াঁজ কুচি, কাঁচাপাকা লঙ্কা, একসাথে খুব ভালোভাবে বেঁটে নিন। বাটা হলে ওই মিশ্রনের সাথে, সেদ্ধ কচু ও পরিমানমত নুন একসাথে বেঁটে নিন। ভালোভাবে বাটা হলে একটি পাত্রে তুলে নিয়ে ওপর থেকে কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে দিন, আর চাইলে ২টো কাঁচালঙ্কা দিয়ে গরম গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করুন কচু বাটা।
রসগোল্লার মালাইকারি:-
উপকরণ :-
রসগোল্লা, গোটা গরম মশলা, আদা বাটা(২বড় চামচ), টমেটো বাটা(২তো মাঝারি সাইজের), গোটা তেজপাতা(২টো), গোটা জিরে, নারকেল কোরা(১ছোট বাটি), নারকেলের দুধ(এখন তো বাজারেই পাওয়া যায়)( ১বাটি), হলুদ গুঁড়ো(১চামচ), লঙ্কার গুঁড়ো(১চামচ), আন্দাজমত নুন – চিনি, ঘি, এবং গরম মশলা গুঁড়ো।
প্রণালী :-
প্রথমে কড়াতে সর্ষের তেল গরম করতে দিতে হবে। তেল গরম হলে তাতে গোটা তেজপাতা, গোটা জিরে আর গোটা গরম মশলা ফোরণ দিতে হবে। তাপর আদাবাটা, টমেটো বাটা দিয়ে ভালো করে কষ্টে হবে, তারপর একে একে হলুদ গুঁড়ো,লঙ্কার গুঁড়ো দিতে হবে, র ভালো করে মশলাটা কষাতে হবে। তারপর আন্দাজমত নুন দিতে হবে এবং চিনি দিতে হবে পরিমানের থেকে কিছুটা বেশি, তারপর অল্প সামান্য একটু জল দিতে হবে যাতে মশলা না পুড়ে যায়। এরপর আর মধ্যে নারকেলের দুধ দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেই রসগোল্লা গুলো দিয়ে দিতে হবে আর একটু ফুটতে দিতে হবে। কিছুক্ষণ বাদে গ্রেভি ফুটে উঠলে, ওপর থেকে নারকেল কোরা ছড়িয়ে দিতে হবে তারপর গ্যাস অফ করে সামান্য একটু ঘি আর গরম মশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে দিতে হবে। কিছুক্ষন পর নামিয়ে গরম গরম ভাতের সাথে, বা রুটি পরোটা, নানের সাথে পরিবেশন করুন রসগোল্লার মালাইকারি।
“এই সব রান্নাগুলি এখন তো আর শোনাই যায়না কারুর বাড়িতে হয় বলে। এই সব রান্নাগুলো খুব পুরোনো দিনের রান্না, বাড়িতে বানিয়ে খেলে মন্দ লাগবে না, খুব সুস্বাদু খেতে হয়।এই সব খেয়ে দেখো একবার, পরে আর ওই বাইরের খাবার তখন মুখে রুচবে না।“
“অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পুষ্প ঠাম্মা, এত সুন্দর অন্যরকম সব জিভে জল আনা রান্না তো বাড়িতে বানাতেই হবে। একটু খাটনি পড়লেও পরে যে কেষ্ট মিলবে। ওই কোথায় বলে না কষ্ট করলে তবেই কেষ্ট মেলে। আজ তাহলে বিদায় সকলকে, আবার নতুন কোনো বিষয় নিয়ে ফিরে আসবো, নমস্কার।“