সুনাম বা বদনাম বই প্রেমী বলে বাঙ্গালীদের একটা আলাদাই পরিচয় আছে। তাইতো, কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া সর্বদাই ব্যস্ততা লেগে থাকে। শুধু নতুন নয় পুরনো বই কেনার ঝোঁকও কম নয় বই মুখো মানুষদের। তাগিদ কেবল বই পড়া। তাই বহু বছর আগে কলকাতার অলিতে গলিতে বিভিন্ন পাড়ায় তৈরি হয়েছিল সাধারণের জন্য পাঠাগার।
সময়ের স্রোতে সবকিছুই বহমান। মলিন হয়ে যায় স্মৃতি। তেমনই কালের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির এক সময় অবসরে বই পড়ে কাটানোর ঠিকানা গুলি। তেমনই এক ঠিকানা হলো ভবানীপুর পাঠাগার। ই- বুক,অনলাইন পিডিএফ এর যুগে কেমন আছে সে পাঠাগার? উত্তরে বলা যায় খুব একটা ভালো নেই। ধিকিধিকি জ্বলছে তার প্রাণস্পন্দন। যৌবনের সেই সোনালি দিন আর নেই। ৭৯ বছর বয়সী এই পাঠাগারে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে রয়েছে প্রায় পঁচিশ হাজার বই। আউট অফ প্রিন্টের দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে বেশকিছু। জানা যায় সাদাকালো যুগে এর গৌরব ছিল বেশ উজ্জ্বল। কচিকাঁচা থেকে বৃদ্ধ বনিতা অবসরের সবাই এসে বই পড়তেন এখানে।
স্থানীয় এক পাঠক বলেন,"আমি ছোটবেলাতেই দাদুর সাথে এখানে আসতাম বই পড়তে। তখন রিডিং রুমে জায়গা পাওয়া যেত না ছুটির দিনগুলিতে আর এখন দেখুন আমি একা বসে আছি।"এমন নয় যে বই প্রেমী মানুষের অভাব। রিসেপসনিস্টের কথায়,"আসলে মানুষ বই পড়তে ভালবাসলেও এক জায়গায় গিয়ে বসে পড়ার মত সময় নেই।"
সত্যিই যে যুগ পাল্টেছে মুঠোফোনের দৌলতে সবকিছু আজ হাতের মুঠোয় তবে লাইব্রেরীর বেহাল অবস্থার জন্য কেবল মুঠোফোনকে দায়ী করা যায় না। করোনা অতিমারী সারা বিশ্বকে জীবনযাপনের এক অদ্ভুত ধারণা দিয়েছে। সশরীরে উপস্থিত না থেকেও সব জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়। সামাজিক দূরত্বের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন কনটেন্টের ওপর জোর দিয়েছে মানুষ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের পিডিএফ-এর আকার ইন্টারনেটের জগতে ছেয়ে গেছে। অনেক প্রকাশনী নিজেদের স্বার্থে বইয়ের পিডিএফ বার করেছে।
তবে অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় যুক্ত লাইব্রেরী প্রতি মানুষের বিমুখতার জন্য। সরকারি উদাসীনতা এক অন্যতম কারণ। সরকার লাইব্রেরী গুলির উন্নতি সাধনে তেমন কোন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেনি। কিন্তু দেখা গেছে বই কেনা তুলনায় বেড়েছে। ই-কমার্স সাইট গুলোতে সস্তায় বই কিনছেন অনেক মানুষ। এক্ষেত্রে বলা যায় আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি যারা বই পড়তে আগ্রহী কিন্তু কেনার ক্ষমতা ছিল না তারা লাইব্রেরীর দ্বারস্থ হতেন। বর্তমানে এমন মধ্যবিত্ত বাঙালির সংখ্যা কমেছে বার্ষিক আয় পূর্বের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায়।
প্রশ্ন ওঠে তবে কি লাইব্রেরী কালে কালে ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে? যেখানে এক ক্লিকে সব তথ্য হাতের মুঠোয় চলে আসে সেখানে বই পেতে তথ্য জোগাড় করা সময়ের অপচয় নয় কি?
শিক্ষক শিক্ষিকারা বলেন যে এখন অধিকাংশ পড়ুয়ারা আবার শিক্ষকেরা থেকে ইন্টারনেটের উপর আস্থা রাখলেও ইন্টারনেট শতভাগ সত্য তথ্য দেয় না ফলে লাইব্রেরির গুরুত্ব এবং বইয়ের গুরুত্ব এখনও অটুট সত্যি তথ্য পাওয়ার জন্য।
বইপ্রেমীদের মত যারা বই হাতে ধরে পড়ে অভ্যস্ত তারা ই-বুক বা কিন্ডেল জিনিসটা ঠিক রপ্ত করতে পারেন না সেভাবে। তাই বই যদি কেনা যায় তো ভালো নইলে লাইব্রেরীই ভরসা। "যদিও লাইব্রেরির মেম্বারশিপ কম তবুও পাঠকেরা এখনো বই হাতে নিয়ে পড়তে ভালোবাসেন তাতেই লাইব্রেরী গুলি বেঁচে আছে।" বললেন অবসরপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান।
সময়ের তালে সব পাল্টেছে। স্কুল কলেজ অফিস সব বাড়ি বসে করতে শিখেছি আমরা। তবে বইয়ের গুরুত্ব আজও অমলিন। কেবল অনীহা লাইব্রেরী গুলির প্রতি। কোথাও পরিকাঠামোর অভাব আবার কোথাও লাইব্রেরিয়ানের পদ খালি। কে পূরণ করবে এই পদ! যদি সরকার সাহায্য না করে। আক্ষেপ রয়েছে অনেকের তবে এভাবেই চলতে থাকলে একদিন সত্যিই হয়তো ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে লাইব্রেরীর অস্তিত্ব।