প্রতি বারের মতো, এ বছরেও রেড রোডে ইদের নমাজে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি ছিল প্রত্যাশিত। তবে এবার তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে আরও এক কৌতূহল ছিল—তাঁর সাথে যোগ দেবেন কি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, দলের যুব নেত্রী ও মমতার ভাগ্নে? গত কয়েক মাস ধরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সম্পর্কের ‘সমীকরণ’ নিয়ে আলোচনা চলছিল। কখনও কখনও অভিষেকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে ‘দূরত্ব’ দেখা গিয়েছে, আবার কখনও মমতা প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি তৃণমূলে ‘শেষ কথা’।
উলেখ্য, তবে গত কয়েক মাসে এই সমীকরণ ‘মসৃণ’ হওয়ার লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে, মুখ্যমন্ত্রীর ইংল্যান্ড সফরের আগে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা কাটানোর ইঙ্গিত মিলেছিল। এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, যখন অভিষেক নিজের নেতৃত্বে দলের সাড়ে চার হাজার প্রতিনিধির একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে প্রবীণ নেতা সুব্রত বক্সী অভিষেককে ‘আমাদের সকলের নেতা’ বলে অভিহিত করেন। এই আবহে, এবারের ইদের নমাজে মমতার সঙ্গে অভিষেকের উপস্থিতি একদম প্রত্যাশিত ছিল। বাস্তবে, সোমবার সকাল ৯টা নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেড রোডে পৌঁছান। তাঁর সাথে ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মন্ত্রী জাভেদ খান। মুখ্যমন্ত্রী এবং অভিষেকের ভাষণে রাজ্য ও দেশজুড়ে সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান ছিল। তাঁরা একযোগে কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন, এবং রাজ্যের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। মমতা বলেন, “লাল আর গেরুয়া এক হয়ে অশান্তি করছে। আমরা বিভাজনের রাজনীতি করি না। ধর্মের নামে ব্যবসা করে কিছু রাজনৈতিক দল।” মুখ্যমন্ত্রী তার ভাষণে সর্বধর্ম সমন্বয়ের উপরও গুরুত্ব দিয়েছেন এবং জানিয়েছিলেন, তিনি সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল। তিনি সতর্ক করেছিলেন, কিছু মানুষ সমাজে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছে, এবং সকলকে এসব প্ররোচনায় পা না দেওয়ার জন্য সাবধান করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কেউ গোলমাল পাকাতে এলে মনে রাখবেন, দিদি আছে।”মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার ভাষণে উল্লেখ করেন যে, ইদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি বিদেশের একটি অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন এবং কলকাতায় ফিরে এসেছেন। তাঁর মতে, ‘‘আমার বাইরে যাওয়া জরুরি নয়। আমাদের লোকেদের শুভকামনা জানানোটা জরুরি।” তিনি অক্সফোর্ডের কেলগ কলেজের ঘটনার উল্লেখ করে, ‘বাম-রাম’ কৌশলকে খোঁচা দেন। তিনি বলেন, “কয়েক জন কলকাতা থেকে টিকিট কেটে গিয়ে প্রশ্ন করেছিল, আপনি কি হিন্দু? আমি গর্বের সঙ্গে বললাম, আমি হিন্দু, আমি মুসলিম, আমি শিখ, আমি ইসাহি। আমি এক জন ভারতীয়।”
প্রসঙ্গত, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে বক্তৃতা করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও তার মাকেই অনুসরণ করে, শান্তির বার্তা দেন। তিনি বলেন, ‘‘কেউ গোলমাল পাকাতে এলে রেয়াত করা হবে না।’’ তাঁর বক্তৃতা থেকে স্পষ্ট ছিল, তিনি কোনো প্ররোচনায় পা না দেওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছেন। এদিনের এই মঞ্চে উপস্থিত হয়ে, মমতা এবং অভিষেকের উপস্থিতি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সম্পর্কের ‘মসৃণতা’ই প্রমাণিত করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে, এই মুহূর্তটি শাসক দলের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে যে, তারা একসঙ্গে প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ইদের নমাজের এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে মমতা ও অভিষেকের উপস্থিতি শুধুমাত্র ধর্মীয় সম্প্রীতির উদযাপন ছিল না, বরং তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে একত্রিত হওয়া, তাদের অভ্যন্তরীণ সমীকরণেরও প্রতিফলন। শাসক শিবিরের জন্য এটি ছিল একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা, যেখানে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকার প্রমাণ মিলেছে।