মহাকাশে আট দিনের সফর কখনও কখনও দীর্ঘায়িত চলে মাসের পর মাস। এমনই এক দীর্ঘ যাত্রা শেষে, ৯ মাস মহাকাশে কাটিয়ে, পৃথিবীতে ফিরেছেন দুই আমেরিকান নভশ্চর সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর। ভারতীয় সময় বুধবার ভোরবেলা ফ্লরিডার সমুদ্রে তাঁদের মহাকাশযান অবতরণ করে। তবে মহাকাশ থেকে ফিরে আসলেও তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অনেক সময় লাগবে। দীর্ঘকাল মাধ্যাকর্ষণহীন পরিস্থিতিতে থাকার পর, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে শারীরিকভাবে ফিরে আসা সবসময় সহজ হয় না।
নাসার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)-এর অভিযানে সাধারণত নভশ্চরদের অন্তত ছয় মাসের জন্য মহাকাশে থাকতে হয়। এর মধ্যে মহাকাশে কাটানো প্রতিটি দিন মানবদেহে নানা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটায়। তবে মহাকাশে থাকা যতটা কঠিন, পৃথিবীতে ফিরে আসার পরও নভশ্চরদের সুস্থ হয়ে উঠতে একটি কঠিন সময় পার করতে হয়। নাসার মহাকাশচারীরা যখন আইএসএস-এ কাজ করেন, তখন তারা মাধ্যাকর্ষণহীন পরিস্থিতিতে দিনযাপন করেন। এই অবস্থায়, শরীরের তরল পদার্থ উপরের দিকে চলে যেতে থাকে, যার ফলে মস্তিষ্কে তরল জমে, মুখমণ্ডল ফুলে যায় এবং পা রোগা হতে থাকে। এই প্রক্রিয়া শরীরের অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় অবস্থাতেও পরিবর্তন ঘটায়। "স্পেস সিকনেস" হিসেবে পরিচিত অসুস্থতা, বমি বমি ভাব এবং মাথা ঘোরার মতো উপসর্গ প্রথম কয়েক দিন মহাকাশচারীদের মধ্যে দেখা দেয়।
শূন্য মাধ্যাকর্ষণে থাকার কারণে, হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়, এবং হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়তে থাকে—যা অস্টিওপোরোসিসের মতো অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। তাই, মহাকাশচারীদের প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হয় যাতে তারা এই শারীরিক পরিবর্তনগুলো মোকাবিলা করতে পারেন। মহাকাশের মাইক্রোগ্র্যাভিটি অবস্থায় চোখের মণির আকার বদলে যেতে পারে এবং রেটিনায় গঠনগত পরিবর্তন ঘটতে পারে, যা দৃষ্টিশক্তির অবনতির কারণ হতে পারে। দীর্ঘকাল শূন্য মাধ্যাকর্ষণে থাকার ফলে, পায়ের তলা নরম হয়ে যায়, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে "বেবি ফিট" বলা হয়। এর ফলে পৃথিবীতে ফিরে এসে প্রথম কয়েক দিন হাঁটাচলা করতেও বেশ কষ্ট হতে পারে। এছাড়া, মহাকাশে মহাজাগতিক রশ্মি এবং ক্ষতিকর সৌর বিকিরণের মধ্যে থাকতে হয় নভশ্চরদের, যার কারণে তাদের ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তবে, নাসা জানাচ্ছে যে নভশ্চরদের ক্যানসারের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের থেকে মাত্র ৩ শতাংশ বেশি।
বাড়ল বোনাস! রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য সুখবর
উলেখ্য, মহাকাশে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে পৃথিবীতে ফেরার পর, নভশ্চরদের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে কষ্ট হয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সংস্পর্শে এসে তাদের "ভেস্টিবুলার সিস্টেম" বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ, প্রথম কয়েক দিন তারা টলমল পায়ে হাঁটেন। কখনও কখনও পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে পড়তে পারে যে, নভশ্চরদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। যেমন গত বছর, ‘ক্রু ড্রাগন’ যানে ফিরতে গিয়ে এক মহাকাশচারীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। একজন মহাকাশচারী, ম্যাথিউ ডমিনিক, জানাচ্ছেন যে, পৃথিবীতে ফিরে সুস্থ হতে কখনও কখনও সপ্তাহ কিংবা মাসখানেক সময় লেগে যেতে পারে। তিনি বলছেন, "কেবল অস্থির হয়ে পড়া কিংবা মাথা ঘোরাই নয়, কখনও কখনও কাঠের চেয়ারে বসার মতো সামান্য কাজও খুবই যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে।" ২০১৫-১৬ সালে মহাকাশ স্টেশনে ৩৪০ দিন কাটানো স্কট কেলির শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা হয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মহাকাশে এতদিন থাকার কারণে তার শরীরের বিভিন্ন কোষে স্থায়ী পরিবর্তন ঘটেছে এবং মাইক্রোবায়োমেও নতুন ধরনের ব্যাকটেরিয়া জন্মেছে। তবে ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং বর্তমানে তিনি আমেরিকার সেনেটরের পদে আছেন। মহাকাশের অনন্য পরিবেশে দীর্ঘকাল থাকার পর, নভশ্চরদের শরীর ও মনের ওপর নানা প্রভাব পড়ে। পৃথিবীতে ফিরে আসার পর, তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া একটি সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন কাজ। তবে, প্রতিটি নভশ্চরই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আবার জীবনের নানা পরিসরে ফিরে আসেন। তাদের এই অদম্য মানসিকতা ও শারীরিক শক্তি, মহাকাশ অভিযানকে আরও অনুপ্রেরণাদায়ী করে তোলে।