পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি, নামে পরিচিত, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী উৎসব। মূলত বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসবটি পালিত হয়, যা সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশের ক্ষণ হিসেবে জ্যোতিষশাস্ত্রে চিহ্নিত। এই দিন বাঙালি সমাজে নানা ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। মকর সংক্রান্তি উৎসবকে ঘিরে ঘুড়ি উড়ানো, পিঠে খাওয়া, পটকা ফাটানো, ফানুস উড়ানো এবং বিভিন্ন ধরনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে।[৪] সারা ভারত উপমহাদেশে এই দিনে বহু দেশীয় বহু-দিনের উৎসবের আয়োজন করা হয়। ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউল গান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ।
প্রসঙ্গত, মকর সংক্রান্তি সূর্য দেবতার মকর রাশিতে প্রবেশের দিন হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে 'সংক্রান্তি' শব্দটি সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশের ঘটনা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই এই দিনটি বিশেষভাবে পালন করা হয়, তবে প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী উৎসবের ধরন ভিন্ন হতে পারে। 'মকর সংক্রান্তি' শব্দটির অর্থ হলো সূর্য যখন মকর রাশিতে প্রবেশ করে, তখন পৃথিবী জুড়ে নানা অনুষ্ঠান ও পূজার আয়োজন করা হয়।
মকর সংক্রান্তি উৎসব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। কেরালায় মকর সংক্রান্তি, আসামে মাঘ বিহু, হিমাচল প্রদেশে মাঘি সাজি, পাঞ্জাবের মাঘী স্যংগ্রান্ড, জম্মুতে মাঘি স্যংগ্রান্ড বা উত্তরায়ণ (উত্তরায়ণ), হরিয়ানায় সক্রাত, রাজস্থানে সক্রাত, ইত্যাদি নামে পরিচিত । মধ্য ভারতের সুকরাত, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাটে উত্তরায়ণ, এবং উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের ঘুঘুটি, বিহারে দহি চুরা, ওড়িশা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, গোয়া, পশ্চিমবঙ্গে মকর সংক্রান্তি (একেও বলা হয়)পৌষ সংক্রান্তি বা মোকর সোনক্রান্তি ), উত্তর প্রদেশ (এছাড়াও খিচিড়ি সংক্রান্তি বলা হয়), উত্তরাখণ্ড (উত্তরায়নীও বলা হয়) বা সহজভাবে, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় সংক্রান্তি ,[৫][৬] মাঘে সংক্রান্তি (নেপাল), সোংক্রান (থাইল্যান্ড), থিংয়ান (মিয়ানমার), মোহন সংক্রান (কম্বোডিয়া), মিথিলায় তিল সাকরাত, মাঘে সংক্রান্তি নেপাল এবং শিশুর সেনক্রথ (কাশ্মীর)। মকর সংক্রান্তিতে, সূর্য দেবতা বিষ্ণু এবং দেবী লক্ষ্মীর সাথে পূজা করা হয় ভারত জুড়ে।
উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে আবহাওয়ার পরিবর্তন
পশ্চিমবঙ্গের পৌষ সংক্রান্তি - পশ্চিমবঙ্গে মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি নতুন ফসলের উৎসব হিসেবে উদযাপিত হয়। বিশেষ করে পিঠে খাওয়া এবং তিল, গুড়, খেজুরের গুড় থেকে তৈরি বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবারের মাধ্যমে উৎসবের আনন্দ বেড়ে ওঠে। বাঙালি পরিবারে এই দিনে পিঠে, পুলি, নানান মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়। পাশাপাশি, এই দিনটি নতুন ফসল সংগ্রহেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যেখানে কৃষকরা তাদের প্রথম ধান বাড়িতে আনে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার পালন করে।
আউনি বাউনি - পশ্চিমবঙ্গে পৌষ সংক্রান্তির দিন বিশেষ একটি অনুষ্ঠান পালিত হয়, যাকে 'আউনি বাউনি' বলা হয়। এটি একটি শস্য উৎসব, যা মূলত নতুন ধান ঘরে তোলার পর অনুষ্ঠিত হয়। ধানের শিষ দিয়ে নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠান করা হয়, যা কৃষি উৎপাদনের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন হিসেবে পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি প্রকৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও জীবিকার উৎস কৃষির প্রতি সম্মান জানায়।
বাংলাদেশে পৌষসংক্রান্তি - বাংলাদেশে পৌষসংক্রান্তি 'সাকরাইন' নামে পরিচিত। পুরান ঢাকায় এই উৎসব বিশেষভাবে উদযাপিত হয়, যেখানে ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি মেলার আয়োজন করা হয়।। ঢাকার নবাবগঞ্জে গরু দৌড় প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বাউল গানের আসর বসে। এই দিনটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে নানা ধরনের খাবার, গান এবং নাচের মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করা হয়।
মকর সংক্রান্তি শুধু একটি কৃষি উৎসবই নয়, এটি আধ্যাত্মিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু ধর্মে এই দিনটি সূর্য দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং পাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য পবিত্র নদী বা হ্রদে স্নান করার একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত। গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, কাবেরী নদীতে স্নান করে অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন যে তারা অতীতের পাপ থেকে মুক্তি পাবে। মকর সংক্রান্তির দিন বিশেষ পূজা-অর্চনা এবং ভক্তির অভ্যাস পালিত হয়।
ঘুড়ি উৎসব - পৌষ সংক্রান্তির দিন বাঙালিরা সারাদিনব্যাপি ঘুড়ি উড়ায়। এইদিন ঘুড়ি উড়ানোর জন্য তারা আগে থেকে ঘুড়ি বানিয়ে এবং সুতায় মাঞ্জা দিয়ে প্রস্তুতি নেয়। ঘুড়ি উৎসব বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। মুঘল আমল থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই উৎসবে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। পুরোন ঢাকার অধিবাসীদের কাছে এটি অত্যন্ত উৎসবমুখর দিন যা সাধারণত শীতকালে পালিত হয়।
মেলা ও অন্যান্য সামাজিক আচার - মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা ও উৎসবের আয়োজন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে সাগরদ্বীপের কপিল মুনির আশ্রমে পুণ্যস্নান এবং বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেমন ঘুড়ি উৎসব, পিঠে খাওয়া, নাচ, গান এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান মকর সংক্রান্তির আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া, তিল ও গুড় দিয়ে তৈরি মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজও বেশ জনপ্রিয়, যা ভালোবাসা, শান্তি এবং আনন্দের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়।
মকর সংক্রান্তি শুধু একটি কৃষি উৎসবই নয়, এটি আধ্যাত্মিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু ধর্মে এই দিনটি সূর্য দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং পাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য পবিত্র নদী বা হ্রদে স্নান করার একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত। গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, কাবেরী নদীতে স্নান করে অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন যে তারা অতীতের পাপ থেকে মুক্তি পাবে। মকর সংক্রান্তির দিন বিশেষ পূজা-অর্চনা এবং ভক্তির অভ্যাস পালিত হয়। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন উৎসব। এটি একটি সামাজিক, ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক উৎসব, যা নানা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে একত্রিত হয়। এই দিনটি কৃষকদের জন্য নতুন ফসল সংগ্রহের উৎসব এবং সূর্য দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। এছাড়া, এর মাধ্যমে সারা পৃথিবীজুড়ে শান্তি, প্রগতি এবং সমৃদ্ধির কামনা করা হয়।