সালটা ১৯৯২, ৬ই ডিসেম্বরের এরকমই একটি সকালে অয্যোধ্যার বুক চিঁরে এগিয়ে চলেছে এক মহা শোভাযাত্রা, কচি থেকে বুড়ো, পুরুষ নারী নির্বিশেষে কনকনে ঠাণ্ডায় কেও চাঁদর কেওবা উলে বোনা সোয়েটার পরে ক্লান্তহীনভাবে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে প্রায় দেড় লক্ষ জনগণ। রাম নামের সেই স্লোগানে অনবরত কম্পিত হয়ে চলেছে গোটা উত্তর ভারত। সনাতনী হিন্দুরা সেদিন একজোট হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো সমগ্র বিশ্বকে। জানান দিয়েছিল সনাতন ধর্মই উন্নতির আসল রূপ। ১৫২৮ সালে মুসলিম সেনাপতি মির বাকি-র রাম জন্মভুমিকে দূষিত করে ‘তুঘলকি চালে” তৈরি করা বাবরের নামাঙ্কিত মসজিদ ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অনধিকার রাজত্ব করার পরে, হিন্দু তথা সনাতনী ‘’কর সেবক’- এর কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। ৯২-এর ‘’রাম রথযাত্রা’ নামাঙ্কিত সেই শোভাযাত্রার আয়োজক ছিল ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ’ যেখানে সামিল ছিলেন বিজেপি এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভ্য-সভ্যারা। লাল কৃষ্ণ আদবানি, উমা ভারতী মুরুলি মনোহর জোশির বিদগ্র ভাষণে কেঁপে গিয়েছিলো সেই সময়ের শাসক দল।
১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে আয়োজিত এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী লক্ষ্যাধিক সনাতনী হিন্দু সারা উত্তর ভারত ঘুরে আজকের এই ৬ই ডিসেম্বর ‘বাবরি মসজিদ’-এর সামনে এসে পৌছায়। রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে সেইদিন শাসক দল আধা-সামরিক বাহিনী মির বাকি , ভারত শাসন করা মুঘল এবং বাবরের সন্মান রক্ষার্থে মসজিদের সামনে মোতায়েন করে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ভারত মায়ের সন্তানদের ইচ্ছে না থাকলেও সেদিন শাসক দলের আদেশে সনাতনী হিন্দুদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। ফলত, বহু কর-সেবক, এবং সনাতনী তারই সঙ্গে বেশ কিছু সামরিক বাহিনীতে কর্মরত সৈনিক আহত হন। তবে , লাল কৃষ্ণ আদবানী শোভাযাত্রা চলাকালিন পূর্ব বিহারে গ্রেফতার হওয়ার আগে সনাতনীদের মনে যে হিন্দু হিসবে জেগে ওঠার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা আধাসামরিক বাহিনী নেভাতে পারেনি। উন্মত্ত জনতা গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করে, কুঠার, হাতুড়ি, গাইতি নিয়ে মির বাকির শক্তি অপপ্রয়োগে তৈরি হওয়া সেই মসজিদ একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করে। রাম নামে গোটা অঞ্চল ধ্বনিত হয়। অবশেষে কিছু ঘণ্টার ব্যাবধানে কাদা ও চুনাপাথর -এর সেই মসজিদভূলুণ্ঠিত হয়। মাটিতে মিশে যায় মুঘলদের শাসনের অপপ্রয়োগের একটি নিদর্শন।
তবে সেই সময়ের শাসকদল ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। সংখ্যালঘুদের পাসে দাড়িয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে লিপ্ত করতে উস্কানি দেয়, ফলত, দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু- মুসলিম সংঘর্ষ পরিলক্ষিত করা যায়। কয়েক হাজার মানুষ এই দাঙ্গায় প্রান হারায়। ভি এইচপি কে নিষিদ্ধ করে। পরবর্তীতে এই ধ্বংসকে নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের থেকে রাজনৈতিক সুবিধার লোভে এই ধ্বংসতে জড়িত থাকা মানুষদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার একটি চার্জশিট বানানোর নির্দেশ দেয় এবং তদন্ত করার পক্ষে সওয়াল করে। যদিও পুরাকালের প্রবাদ ‘ধর্মের কল বাতাসে নরে’ -কথাকে সত্য করে পরবর্তীতে এই ধ্বংসযজ্ঞে সামিল সবাই নির্দোষ প্রমাণিত হয় এবং বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
তবে এই সুযোগ কাজে লাগায় ভারতের দুই পড়শি দেশ বাংলাদেশ এবং পাকিস্থান। একদিকে পাকিস্থানে হিন্দু মন্দির-এ আগুন লাগানোর সাথে সাথে পাকিস্থান থেকে যে দুষ্কৃতি ভারতের বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করার বাহানায় দেশে আত্মগোপন করেছিলো, তাঁরা সুযোগ বুঝে হিন্দু ধর্মকে বেয়াব্রু করার আছিলায় বিভিন্ন দেশদ্রোহী স্লোগান দিতে থাকে এবং ভারতীয় মুসলিমদের খেপিয়ে তোলে, আর এর ফলেই দাঙ্গা চরম আকার নেয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাকিস্থান ঘেঁষা মানুষেরা সুযোগ বুঝে হিন্দু মন্দির এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। ৯৩ সালের দুর্গাপুজোতে যা বড় আকার নেয় এবং বহু হিন্দুদের প্রানে মেরে ফেলা হয়। এমনকি এর আঁচ পশ্চিমা দেশ গুলিতে পর্যন্ত পড়েছিল। এতো কিছু হওয়ার পরও ২০০৯ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এই দেশের মুসলিমের পাশে দারায় এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
পরবর্তীতে রামের জন্মভূমিতে ‘’রাম্ মন্দির’ ছিল নাকি মুঘলদের তৈরি ‘বাবরি মসজিদ’ ছিল তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়, এবং অবশেষে ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে ওই অঞ্চলে রাম মন্দির ই ছিল এবং তার বেশকিছু প্রমাণ-ও দেখানো হয়। ২০২০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃতে পুনরায় সেই অঞ্চলে ‘রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ২০২৪ সালের ২২শে জানুয়াররি- শুভক্ষণে ‘রামলালা’ পুনরায় তার ঘরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যদিও এমন একটি পবিত্র প্রতিষ্ঠার কাজ কোনো ধার্মিক মানুষকে না দিয়ে মোদী নিজে প্রতিষ্ঠা করায় বিস্তর সমালোচিত হন।
তবে এই ভাঙ্গন সর্বসাধারণকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যা নিজের তা যদি অন্যকেউ অধিকার করে নেয় তাহলে তা ভালবাসায় না দিলে বলপ্রয়োগ করে নিতে হয়, আর সেটা মন্দির-মসজিদ হউক বা দেশ।