তসলিমা আশা করেছিলেন, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং গণতান্ত্রিকভাবে সরকার নির্বাচিত হবে। প্রাথমিকভাবে সেই ভাবনাতেই হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তিনি সঠিক মনে করেছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি।
তসলিমা বলেছেন, “পরে আমরা বুঝতে পেরেছি এটা মোটেও ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না। ইসলামি মৌলবাদীরা এর পরিকল্পনা করেছিল এবং টাকা দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মূর্তি, জাদুঘর ও জাতীয় ঐতিহ্যের ভাস্কর্য ধ্বংস করা শুরু হলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছিল। এরপর জেলে বন্দি সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং হিন্দুদের উপর হামলা শুরু হয়। তখন আন্দোলনকারীদের আসল উদ্দেশ্য ও চেহারা প্রকাশ্যে আসে।”
তসলিমার আরও বলেছেন, “ইউনূস বলেছেন বিক্ষোভকারীরা বিজয় উদযাপন করেছে। কিন্তু এটা কেমন উদযাপন যেখানে হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়ানো হচ্ছে? যুদ্ধের সময় লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করা এবং মহিলাদের ধর্ষণ করা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূর্তি স্থাপন করা হচ্ছে। ইউনুস জানেন জিহাদিরাই দেশ শাসন করবে এবং এতে তাঁর কোনও সমস্যা নেই। এই কট্টরপন্থীরা বাংলাদেশকে পরবর্তী আফগানিস্তান বা ইরানে পরিণত করার জন্য নরক বানাতে চায়। ইউনূস এই ধরনের লোকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না এবং তাদের সমালোচনাও করছেন না। কাজেই ভবিষ্যতের জন্য কোনও আশা নেই।”
তবে, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনাকেই দায়ী করেছেন তসলিমা। কারণ, মৌলবাদীরা হঠাৎ করে মাথা তোলেনি। তিনি বলেন, “এর জন্য হাসিনাই দায়ী। তিনি ক্ষমতায় থাকার জন্য মৌলবাদীদের তুষ্ট করেছেন। ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন তিনি। মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমতুল্য করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন। তিনি আমাকে হেনস্থা করেছিলেন বলে আমি হাসিনার বিরুদ্ধে নই, আমি হাসিনা বিরোধী কারণ তিনি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। সেখানে জিহাদিরা হঠাৎ করে মাথা তোলেনি। হাসিনার শাসনামলে হিন্দুদের উপর সবথেকে বেশি হামলা হয়েছে।”
বর্তমানে বাংলাদেশে তরুণদের মগজ ধোলাই করছে ইসলামী কট্টরপন্থীরা। তাদের ভারতবিরোধী, হিন্দুবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী এবং জিহাদিতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। কাজেই, খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ আরও একটা আফগানিস্তানে পরিণত হতে পারে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার এ কথা বলেছেন তসলিমা নাসরিন। তিনি যেটা ছাত্রদের আন্দোলন মনে করেছিলেন, তা আসলে ছিল মৌলবাদীদের চক্রান্ত।
বাংলাদেশে জুলাই- অগস্ট মাস থেকেই অশান্ত পরিস্থিতি । নিজের দেশে প্রবেশের অধিকার নেই, তবুও সমানে প্রতিবাদে গলা তুলছেন তসলিমা নাসরিন। এবার তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এল তাঁর ও তাঁর পরিবারের উপরে হওয়া পার আর্মির অত্যাচার।
বহুদিন হল বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন না তিনি। তবে নিজের জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা আর টান বর্তমান। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রমাগত দেশের পরিস্থিতি নিয়ে পোস্ট করে চলেছেন বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিন। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে বলে, একাধিক পোস্টে দাবি করেছেন তিনি। এমনকী, সেই অত্যাচারের ছবি-ভিডিয়োও এনেছেন সামনে। দেশের অভ্যন্তরে তৈরি হওয়া ভারত বিদ্বেষ, পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে তৈরি হওয়া সুসম্পর্ক, নানা জিনিস উঠে এসেছে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে।
এবার স্মৃতিচারণ করলেন ৭১-এর ঘটনা নিয়ে। লিখলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি নিতান্তই শিশু। ওই বয়সেই গোটা একটা যুদ্ধের বোঝা কাঁধে নিয়ে চলতে হয়েছে, দেখতে হয়েছে মানুষের লাশ, দেখতে হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়ে যাওয়া। শহরে নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে অচেনা মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গিয়েছি। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছে আমাদের কালো মোষের গাড়ি, সেই গাড়ির ভেতরে ভয়ে কেঁপে কেঁপে পার করেছি সারা সারা রাত। কত কত দিন ঘুমোবার ভালো বিছানা পাইনি, ভরপেট খেতে পাইনি। এভাবে ন'মাস কেটেছে। শহরের বাড়ি লুঠ করেছে পাকিস্তানি আর্মি, বাবাকে মেরে আধমরা করে গেটের কাছে ফেলে রেখে গেছে। বিছানায় শোয়া আমার ওপর টর্চ ধরে রেখেছিল আর্মি। ওই শিশু বয়সেই গভীর ঘুমের অভিনয় করে পড়ে থাকতে হয়েছিল। বুক কাঁপছিল, এই বুঝি মেরে ফেলবে, এই বুঝি তুলে নিয়ে যাবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আমাদের দুশ্চিন্তা যায়নি, কারণ মামা তখনও মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরেনি। গোলাগুলির মধ্যে, ভয়ের মধ্যে, লাশের মধ্যে, নৃশংসতার মধ্যে কাটানো শিশুর শৈশব থাকে না।’
আসলে তসলিমার এই স্মৃতিচারণের কারণ হল, বাংলাদেশে তৈরি হওয়া ‘অস্থির পরিস্থিতি’। আর এই ঘটনাগুলি যে তাঁকে কতটা আঘাত করছে, তা তাঁর সোশ্যাল পোস্ট থেকেই স্পষ্ট। তাই তো ভারতে বসেও, সেদেশের মানুষদের জন্য মন কাঁদছে তাঁর। তিনি লিখেছেন, ‘৫৩ বছর পার হয়েছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কোনওদিন কল্পনাও করিনি, এই দেশ একদিন স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের হাতে চলে যাবে। যে রাজাকাররা ছিল পাকিস্তানি আর্মির সহযোগী, যারা বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছে লুঠ করার জন্য, মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে খুন করার জন্য, তরুণী দেখিয়ে দিয়েছে ধর্ষণ করার জন্য। কল্পনাও করিনি এই কুলাঙ্গারগুলোর হাতে, অথবা এই কুলাঙ্গারগুলোর সমর্থকদের হাতে একদিন দেশ চলে যাবে। একদিন আমরা পরাধীন হয়ে পড়বো নিজের স্বাধীন দেশে। একদিন দেখবো ক্ষুদে কুলাঙ্গাররা দল বেঁধে ধেয়ে আসছে আমাদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে, আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে। ধেয়ে আসছে আমাদের প্রাণের সংগীত, আমাদের প্রাণের পতাকা ছিনিয়ে নিয়ে পায়ে পিষতে।’
প্রসঙ্গত বাংলাদেশের অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অগস্ট মাস থেকেই। হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আর অভিযোগ, সেই আন্দোলনেই ছাত্রদের উপর গুলি চালায় সেই দেশের পুলিশ। অনেক তরুণ প্রাণ অকালে প্রাণ হারায়। তারপরই সাধারণ মানুষরা সকলে নামেন পথে। অবস্থা এমন হয় যে হাসিনা পদত্যাগ দিয়ে পালিয়ে আসেন ভারতে। আপাতত বাংলাদেশের দায়িত্ব মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে। কিন্তু পরিস্থিতি খুব একটা শুধরোয়নি।
তসলিমা তাঁর এই পোস্টে আরও লিখেছেন, ‘দেশটা যে আবার পরাধীন হয়ে গেল। এই পরাধীনতার দায় আমি দিতে চাই দেশের প্রতিটি শাসককে। মুজিব, জিয়া , এরশাদ, খালেদা, হাসিনা ---- সকলেই হয় রাজাকারদের ক্ষমা করেছে, নয় রাজনীতিতে এনেছে, নয় মসনদে বসিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজাকারদের যেহেতু খাদ্য ইসলাম, এই ইসলামের চাষ করেছে সকলে। …ইসলাম যদি তুমি নাকে মুখে মনে মস্তিস্কে ঠেসে খাওয়াও, তবে আজ যে পঙ্গপালের মতো কুলাঙ্গার জন্মেছে, তা জন্মায়। এবং তোমাকে বাকি জীবনের মতো পরাধীনতার শেকলে বেঁধে ফেলে। কোনও শাসকই গণতন্ত্র চায়নি, সবাই আমৃত্যু গদিতে বসে আরাম করতে চেয়েছে। কোনও শাসকই দেশের ভালো নিয়ে ভাবেনি, সকলেই নিজের ভাল ভেবেছে। আজ তাই দেশকে ধ্বংস করার কুলাঙ্গারে দেশ ছেয়ে গেছে।’
- বক্তা বাংলাদেশের নির্বাসিত বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।