১৯২৫ সালের ২রা ডিসেম্বর, অবিভক্ত বাংলার ঢাকাই জন্মেছিলেন বাঙালির প্রিয় অভিনেতা সন্তোষ দত্ত। না! জটায়ু বললেই মনে হয় বেশি ভালো হবে। মঞ্চাভিনেতা বাবা তার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে যেতেন গিরিশ ঘোষের নাটক দেখতে। সেখান থেকেই সূত্রপাত, হইত সেটা না হলে সন্তোষ দত্ত তার ওকালতির জীবনেই সীমিত থেকে যেতেন, আর বাঙালি সমাজ বঞ্চিত হত লালমোহন বাবুর হিন্দি বলার রকম থেকে। তবে ছোট থেকে অভিনয় পেশাই যুক্ত হওয়ার কোন ইচ্ছে সেই রকম ভাবে ছিল বনা সন্তোষ দত্তের মধ্যে, ইচ্ছে ছিল আইনজীবী হওয়ার। তবে প্রথম জীবনে তিনি প্রায় ১৪ বছর ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন যা বর্তমানে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, হঠাৎ করে উড়িষ্যাই বদলির আদেশ পেয়ে বাঙ্কিং পেশাই ইতি টেনে ছিলেন লালমোহন বাবু। চাকরি ছাড়ার পরে অবশ্য বসে থাকতে হয়নি তাঁকে, ওকালতির পড়াশোনা আগেই করা ছিল যুক্ত হয়ে গেলেন নিজের পছন্দের পেশাই। আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতেই খুলে ফেললেন চেম্বার। সন্তোষ দত্ত অতিসাধারণ জীবন যাপন করতে ভালোবাসতেন। বাবা মা মারা যাওয়ার পরে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সেই বাড়িতেই স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে থাকতেন সন্তোষ দত্ত।
বাঙালির প্রিয় সন্তোষ দত্ত জীবিকা আর ইচ্ছের মধ্যে কোন দিনই দূরত্ব বজায় রাখেন নি, ওকালতির সাথে চালিয়ে গেছেন মঞ্চ কাঁপানো অভিনয়ও। সালটা ১৯৫৪-৫৫ রুপকার নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার সবিতাব্রত দত্তের পরিচালনাই মঞ্চস্থ হল সুকুমার রায়ের লেখা এক নাটক, অভিনয় করলেন সন্তোষ দত্ত, আর দর্শক আসনে স্বয়ং সত্যজিৎ। সন্তোষ দত্তের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তিনি সন্তোষ দত্তকে বলেই ফেললেন “বাবা হইত আপনার জন্যই চরিত্র টা কল্পনা করেছিলেন”, ব্যাস একজন অভিনেতার কাছে প্রথম জীবনেই সত্যজিৎ এর সার্টিফিকেট পাওয়ার থেকে আর বড় কিছু হতে পারে না। তারপরেই সুযোগ পেলেন সত্যজিৎ রায়ের “পরশ পাথরে”। এরপর অবশ্য পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। তার পরেই বাঙালি পেলো তাদের লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুকে। ফেলু মিত্তিরের সাথে জটায়ুর প্রথম সাক্ষাৎ হোক বা উঠের পিঠে চেপে রাজস্থান ভ্রমন সব কিছুই বাঙালির কাছে নতুনের মতই। তবে সোনার কেল্লার জটায়ু হাত ছাড়া হচ্ছিলো আর একটু হলেই, তখন তিনি মামলা নিয়ে দিন রাত খেটে চলেছেন, হঠাৎ সত্যজিৎ রায়ের ফোন জানালেন সোনার কেল্লার শুটিং এর জন্য এক মাস রাজস্থানে যেতে হবে। তখনকার দিনে মামলার দিন পেছন এত সহজ ছিল না, ওপর দিকে মানিক বাবুকেও না করা যাবে না। সন্তোষ দত্তের এই পরিস্থিতিতে সাহায্য করলেন তারই বিরোধী পক্ষের উকিল, দুই উকিল একসাথে আর্জি জানালেন জজ সাহেবের কাছে, আর অনুমতিও পেলেন।
এরপর একের পর এক চিরস্মরণীয় চরিত্র হীরক রাজার দেশের বিজ্ঞানী থেকে ওগো বধূ সুন্দরীর অবলাকান্ত, বহু মানুষের ভালোবাসা তার ঝুলিতে। পরশ পাথরের শুটিং শেষে সত্যজিৎ রায় তাঁকে ডেকে বলেন, “আপনার জন্য ৭৫০ ফিটের রিল আমি ধার্য করেছিলাম, আপনি ২৫০ ফিটে কাজ শেষ করেছেন”। হাস্যকৌতুক সন্তোষ দত্তকে কোন দিন চটকের ব্যাবহার করতে হয়নি মানুষকে হাসানর জন্য। সবথেকে মজার ব্যাপার হল জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমার শেষে জটায়ু যখন সন্ন্যাসি বেশে গঙ্গার ধারে বসেছেন তখন লোকে তাঁকে প্রণাম করতে শুরু করেছিলেন আর যা দেখে স্তম্ভিত হয়েছিল গোটা ইউনিট। একাধারে দুঁদে উকিল অন্য দিকে কৌতুক প্রবন এক অভিনেতা খুব কম মানুষই এই অপরিসীম গুনের অধিকারি হয়। সালটা ১৯৭১ তখন মানুষ লালমোহন গাঙ্গুলিকে এক নামে চেনে, কিন্তু অতিসাধারণ মানুষটির মধ্যে কোন দিনই স্টার সুলভ আচরণ দেখা যাইনি, তখনও তিনি বাসে ট্রামে ঝুলতে ঝুলতে আদালতে আসতেন। এরপর অনেকের জোরজারে শেষ পর্যন্ত কিনে ফেলেন সেই বিখ্যাত সবুজ অ্যাম্বাসেডর, যা এখনও বাঙালির কাছে পরিচিত “জটায়ুর গাড়ি” নামেই।
সত্যজিৎ রায়ের ছবি ছাড়াও পূর্ণেন্দু পত্রির মালঞ্চ, তরুন মজুমদারের গণদেবতা, সলিল দত্তের ওগো বধূ সুন্দরী, উমানাথ ভট্টাচার্যের চারমূর্তি, ঘটকালি আরও অনেক চলচিত্র উপহার তিনি বাংলা সিনেমাকে দিয়ে গেছেন। ১৯৮৮ সালের ৫ই মার্চ উঠের পিঠে চরে জীবন মরুভূমি থেকে বিদায় নিলেন জটায়ু। মারা যাবার পর বেশ কিছু দিন কেটে গেছে, সত্যজিৎ রায় আর ফেলুদা করছেন না। হঠাৎ সত্যজিৎ রায়ের বিশপ লেফ্রয়ের বাড়িতে গেলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী, থাকতে না পেরে তিনি বলেই ফেললেন আপনি কি আর ফেলুদা করবেন না, এর উত্তরে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন “ কাকে নিয়ে করব আমার জটায়ু তো চলে গেল”, তারপর সত্যজিৎ রায় আর ফেলুদা করেননি। মৃত্যুর পর অনেক দিন কেটে গেছে ফেলুদা চরিত্রে অনেকেই অভিনয় করেছেন কিন্তু সন্তোষ দত্ত কেউই হয়ে উঠতে পারেননি। আজও বাঙালি মননে তিনিই এক এবং অদ্বিতীয়। আজ ২রা ডিসেম্বর তার ৯৬ তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা জানাই তাঁকে হাজারো সেলাম।